Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

নেট-রঙ্গের ফোড়নে বিহারে মজেছে বাংলা

শেষ পর্যন্ত কি রসিক বাঙালিরই জয় হল? রবিবার সকালে সোশ্যাল মিডিয়া, হোয়াট্‌সঅ্যাপে বিহারের ভোট নিয়ে ঠাট্টা-মস্করার হিড়িক দেখে সেটা মনে হতেই পারে।

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:৪৬
Share: Save:

শেষ পর্যন্ত কি রসিক বাঙালিরই জয় হল?

রবিবার সকালে সোশ্যাল মিডিয়া, হোয়াট্‌সঅ্যাপে বিহারের ভোট নিয়ে ঠাট্টা-মস্করার হিড়িক দেখে সেটা মনে হতেই পারে।

নেটপাড়ায় জনপ্রিয় একটি কার্টুনে যেমন দেখা গিয়েছে, আকাশে উড়ে যাওয়া রকেটবাজির সঙ্গে মুখ চুন করে উড়ে যাচ্ছেন ‘নরেন্দ্র মোদী’ ও ‘অমিত শাহ’। নীচে দাঁড়িয়ে তাঁদের টা-টা করছেন লালু প্রসাদ ও নীতীশ কুমার। ‘হ্যাপি দিওয়ালি’ লেখা এই কার্টুন সকাল থেকেই উড়ছে ফেসবুক ও হোয়াট্‌স অ্যাপে।

নির্ঘণ্ট পাল্টে দিওয়ালির উৎসব যেন দু’দিন আগেই শুরু হয়ে গেল। শুধু সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালই নয়, ছুটির দিন বেলা ১০টা বাজতে না-বাজতেই শব্দবাজির উল্লাসও টের পেয়েছে কলকাতা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে রাজ্যের তখ্‌তে সেখানকার শাসক দলের কোনও কোনও নেতা স্বভাবতই উচ্ছ্বাসে মেতেছেন! সেই সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়া-দুরস্ত নাগরিকদের একাংশের অবস্থান ভালই মালুম হয়েছে। মজাদার ফোড়ন বা ব্যঙ্গচিত্র নিয়ে এ দিন যা মাতামাতি, তা দেখলে কে বলবে ‘কার্টুন’ শেয়ার করেই বছর দুয়েক আগে কলকাতায় জনৈক অধ্যাপককে হাজতে রাত কাটাতে হয়েছিল!

পুরনো কথা থাক। এ দিন শুধুই বিহারে বুঁদ বাংলা! সেখানে ভোট-প্রচারের ধাপে ধাপে গরুকে বা উগ্র দেশপ্রেমকে তাস বানিয়ে রাজনীতি যে পছন্দ হয়নি, অনেকেই রাখঢাক না-করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। অনেকেরই পাতায় পাতায় এ দিন, সাফ বাংলায়,
‘বিহারে মোদী হাওয়া!’ লালু-নীতীশের কাছে মোদী-অমিত শাহদের ‘গো-হারান’ হারের কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন অনেকে। আবার ব্যঙ্গচিত্রে গরুর ‘মন কি বাত’-ও শোনা গিয়েছে। গরুটি বিরসমুখে বলছে, ‘দুধ, দই নিলে নাও, ভোট চাইলে শুধু গোবর
পাবে!’ আর একটি কার্টুনে সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরা-মাইকের সামনে ‘ভোট শেষ, আমি এ বার বাড়ি যাই’— বলে বেরিয়ে আসছে একটি গরু! নীচে ইংরেজিতে লেখা, ‘বিহার এগ্‌জিট পোল’। বিহারের ভোটপ্রচারে ‘গো মাতা’র সম্মান নিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিজেপির প্রচার অনেকেরই পছন্দ হয়নি। এ দিন অনেকেই ফেসবুকে তাদের বিঁধেছেন— ‘যারা মানুষের থেকে বেশি গরুর কথা বলে ভোট চায়, শেষমেশ তাদের কপালে ভোট নয়, গোবরই জোটে।’

আর একটি কার্টুনে ধ্বস্ত চেহারার ভোট-ভিক্ষুক মোদী ও অমিত শাহ। তলায় লেখা, ‘গরু ও পাকিস্তানের নামে একটি ভোট দিন বাবা!’ লালু-নীতীশকে কার্যত ‘পাকপন্থী’ বলে প্রচার করেছিল বিজেপি। বলেছিল, বিজেপি হারলে পাকিস্তানেই বাজি ফাটবে। হারের পর এ-সব
বুলিও তাদের দিকে ব্যুমেরাং হয়ে ধেয়ে এসেছে। বিজেপির ভোটযুদ্ধের সেনাপতি অমিত শাহের উদ্দেশে কেউ কেউ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বাজির শব্দ শুনে এটা ‘অন্য দেশ’ ভাববেন না, দেশের লোকই উল্লাস করছে।’

দিনের শুরুটা অবশ্য ঠিক এ রকম ছিল না। ভোট গোনা শুরুর প্রথম ঘণ্টায় পাল্লা বিজেপির দিকেই ঝুঁকে ছিল। তখন পটনায় বিজেপির সমর্থকদের ‘জশন’-এর ছবিও সোশ্যাল মিডিয়ার কার্টুনে দেখা যায়। যেমন, হাতির পিঠে মোদী-অমিত, সামনে সন্ত্রস্ত লালু-নীতীশ। বিহারে বিজেপির বিপুল আতসবাজি, লাড্ডুর বরাত দেওয়ার খবরও নেটে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিছু ক্ষণের মধ্যেই খেলাটা ঘুরে যায়। পাটুলির এক তৃণমূল কাউন্সিলর রসিকতা করলেন— ‘দমদমে ভোট গোনা শুরুর সময়ে লাল আবির খেলে সিপিএমের হেরে যাওয়া মনে পড়ে গেল!’

এর পরই বাঙালির ঠাট্টা শুরু! বিহারের মিথিলাই যে রামায়ণের সীতার বাপের বাড়ির দেশ, কেউ মনে করিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, রামের শ্বশুরবাড়ির দেশ তথাকথিত রামভক্তদেরই ফিরিয়ে দিল। এই ফল, আডবাণীর ‘জন্মদিনের উপহার’ বলে কেউ খোঁচা দিয়েছেন। আবার দ্ব্যর্থক ব্যঞ্জনায় লেখা হয়েছে, বিজেপিকে রুখে দিল ‘অটল বিহারী!’ রসিকতার নিশানায় বিজেপি-ভক্ত অভিনেতা অনুপম খের এব‌ং যোগগুরু রামদেবও। সদ্য দিল্লিতে বিজেপির হয়ে পথে নামার পরে, এ দিনের একটি কার্টুনে প্রধানমন্ত্রী অনুপম খেরকে অস্কার তুলে দিচ্ছেন। অস্কারের মূর্তিটা যোগরত রামদেবের মতো। দু’দশকের পুরনো ‘বেটা’ ছবি-র একটি কমেডি দৃশ্যে অনুপমের বিধ্বস্ত চেহারার ছবি ব্যবহার করে বলা হয়েছে, ভোটের ফল বেরোনোর পরে এই তাঁর হাল!

বিহার নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার মাতামাতি দেখে মজা পাচ্ছেন সমাজতত্ত্বের শিক্ষক রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায়। বলছেন, ‘‘পাড়ার
আড্ডা এখন ফিকে। সোশ্যাল মিডিয়া, নেট— একটা বিকল্প সামাজিক পরিসর হয়ে উঠেছে।’’ এই সামাজিকতার অঙ্গ হিসেবেই এসেছে রসিকতা। গত লোকসভা ভোটের আগে মোদী, রাহুল গাঁধী, অরবিন্দ কেজরীবালদের কার্টুন সংস্করণ ফেকু, পাপ্পু ও কেজরুরা নেটপাড়া মাতিয়েছিলেন। সমাজতত্ত্ববিদদের পর্যবেক্ষণ, এখন সকলেই গ্লোবাল। নেট-রঙ্গে বিশ্বকাপ ফুটবল বা বিহারের ভোট, কোনওটাই ব্রাত্য নয়।

বিশ্বের সঙ্গে এই যোগের সূত্র ধরে বিহার-ভোট নিয়ে বাঙালির আড্ডায় ঢুকে পড়েছেন রবীন্দ্রনাথও। ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহার-ও, সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও!’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE