Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
West Bengal News

গ্রাম নয়, সমিতি নয়, বাংলার মন বুঝতে জেলা পরিষদে নজর অমিত শাহদের

পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলা পরিষদ হল এমন একটি স্তর, যে স্তরের প্রার্থীকে ব্যক্তিগত ভাবে চেনা অধিকাংশের পক্ষেই সম্ভব হয় না। কারণ কোনও ব্লকে দু’টি, কোথাও তিনটি করে জেলা পরিষদ আসন থাকে। এলাকা হয় অনেকটা বড়। ফলে জেলা পরিষদের ভোটের ক্ষেত্রে সিংহভাগ ভোটারই প্রতীক দেখে ভোট দেন, প্রার্থীর নাম দেখে নয়।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৮ ১৭:৪২
Share: Save:

নজর রাখছেন খোদ অমিত শাহ। রাজ্য বিজেপির নেতারা সে নিয়ে প্রকাশ্যে খুব বেশি কিছু বলছেন না। কিন্তু পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে বেজায় চাপে রয়েছে ৬ নম্বর মুরলীধর সেন লেন।

বাংলার পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিকে সর্বক্ষণ নজর রাখছে দেশের শাসক দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। বিজেপি বা কংগ্রেসের মতো সুবৃহৎ জাতীয় দলগুলির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব কোনও রাজ্যের পঞ্চায়েত বা পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে খুব ভাবিত, এমনটা বেশ বিরল। কিন্তু বাংলার পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে এ বার সেই বিরল ঘটনাই ঘটছে। বিরল তৎপরতা যে রয়েছে, বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব সে কথা মেনেও নিচ্ছেন। জেলা পরিষদ আসনগুলিতে কেমন চেহারা নিচ্ছে লড়াই, মূলত সেই দিকেই নজর রাখছেন অমিত শাহরা।

বাংলায় এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপির সম্ভাবনা যে খুব উজ্জ্বল, তা কিন্তু নয়। নির্বাচনকে ঘিরে যে সন্ত্রাসের আবহ রয়েছে, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ কমই। ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের বহু আসনে বিরোধী দলগুলির প্রার্থীই নেই। বামফ্রন্ট বা কংগ্রেসের তুলনায় বিজেপির অবস্থা কিছুটা ভাল। কিন্তু কোনও স্তরেই ১০০ শতাংশ প্রার্থী দেওয়ার ধারেকাছে পৌঁছতে পারেনি বিজেপি।

পঞ্চায়েতি লড়াইয়ে নিজেদের ঘরটা যে এত অগোছালো হয়ে রয়েছে, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তা কি জানেন না? নিশ্চয়ই জানেন। তা সত্ত্বেও এই ভোটের ফলাফলের দিকে এত উদগ্র হয়ে তাকিয়ে থাকার কারণ কী? কারণটা হল নিজেদের অস্তিত্বের সঠিক হিসেবটা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা। খবর রাজ্য বিজেপি সূত্রের।

২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে বা ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে এ রাজ্যে বিজেপি-র ভোট বৃদ্ধির ইঙ্গিত মিলেছিল ঠিকই। কিন্তু ওই দুই নির্বাচনের কোনওটিতেই বিজেপি রাজ্যের প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে উঠে আসতে পারেনি। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বিধানসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোট খারাপ ফল করার পর থেকে এ রাজ্যে বিজেপি প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে উঠে আসতে শুরু করেছে। বেশ কয়েকটি উপনির্বাচন সেই ইঙ্গিত দিয়েছে। বাংলার রাজনীতিতে এই নতুন প্রবণতা দেখা দেওয়ার পরে পঞ্চায়েত নির্বাচনই প্রথম অবকাশ, যখন গোটা রাজ্য জুড়ে নিজেদের শক্তি যাচাই করে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে বিজেপি। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সেই কারণেই অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে এই নির্বাচনের ফলাফলের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন বলে রাজ্য বিজেপি সূত্রের খবর। পঞ্চায়েতের ফলাফলে যদি প্রমাণিত হয় যে, বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসকে অনেক পিছনে ফেলে বিজেপি বাংলায় তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে উঠে আসতে পেরেছে, তা হলে ২০১৯-এর জন্য এ রাজ্যে কোমর বেঁধে নামবেন অমিত শাহরা। মুরলীধর সেন লেন সূত্রে তেমনই জানা যাচ্ছে।বিজেপি যে এ বারের পঞ্চায়েতে জেলা পরিষদের লড়াইয়েই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, তা কিন্তু স্পষ্ট। নেতারা মুখে সে কথা খুব সরাসরি স্বীকার করছেন না। কিন্তু নির্বাচন যত কাছে আসছে, বিজেপির সেই রণকৌশল ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

রাজ্যে গ্রাম পঞ্চায়েতের মোট আসনসংখ্যা ৪৮ হাজার ৬৫০। মনোনয়ন পর্ব মেটার ঠিক পরেই নির্বাচন কমিশন সূত্রে যে হিসেব পাওয়া গিয়েছিল, সেই হিসেব বলছে, বিজেপি প্রার্থী দিতে পেরেছে ২৩ হাজার ৪৪৫টি আসনে। পঞ্চায়েত সমিতির মোট আসন, ৯ হাজার ২১৭। বিজেপি প্রার্থী দিয়েছে ৫ হাজার ২১৮টি আসনে। আর জেলা পরিষদের মোট আসন ৮২৫টি। বিজেপি লড়ছে ৬২৯টি আসনে।

কমিশন সূত্রে পাওয়া এই হিসেব বলছে, গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে শতাংশের বিচারে বিজেপি উপস্থিত ৪৮.১৯ ভাগ আসনে। পঞ্চায়েত সমিতির ক্ষেত্রে তা দাঁড়াচ্ছে ৫৬.৬১ শতাংশ আসনে এবং জেলা পরিষদে ৭৬.২৪ শতাংশ আসনে।

বিজেপির নিজস্ব হিসেব অবশ্য এর চেয়ে কিছুটা আলাদা। রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলছেন, জেলা পরিষদ স্তরে ৮১ শতাংশের বেশি আসনে বিজেপি লড়ছে। পঞ্চায়েত সমিতিতে লড়ছে ৭৫ শতাংশ আসনে। আর গ্রাম পঞ্চায়েতে ৫১ শতাংশের বেশি আসনে। এই হিসেব খুব স্পষ্ট করেই বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, গ্রাম পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতি স্তরের চেয়ে জেলা পরিষদে বিজেপির উপস্থিতি অনেক বেশি।

জেলা পরিষদে বিশেষ নজরের প্রমাণ আরও আছে। জলপাইগুড়িতে কয়েক দিন আগেই এক জনসভায় বিজেপি নেতা মুকুল রায় বলেন, জেলা পরিষদে বিজেপি জিতলে ১৮ বছরের উপরের সব তরুণ-তরণীকে স্মার্ট ফোন দেওয়া হবে। মুকুল রায়ের এই ঘোষণার তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়ে‌ছে তৃণমূলে। মুকুলের বিরুদ্ধে নির্বাচনী বিধি ভাঙার অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু তৃণমূল যে পদক্ষেপই করুক, মুকুল রায়ের ঘোষণাতেও স্পষ্ট যে, জেলা পরিষদে যতটা বেশি সম্ভব ভোট টানাকেই আপাতত মাছের চোখ করেছে বিজেপি।

দলের এই রণকৌশলের কথা অবশ্য সরাসরি স্বীকার করছে নেতৃত্ব। রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ বললেন, ‘‘শুধু জেলা পরিষদ কেন, সব স্তরকেই আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। আমি তো বরং বলব, বেশি করে আমরা গ্রাম জিততে চাইছি।’’কিন্তু হিসেব তো অন্য কথা বলছে। গ্রাম পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতির তুলনায় জেলা পরিষদের লড়াইয়ে বিজেপি-র উপস্থিতি তো অনেক বেশি। দিলীপ ঘোষ বললেন, ‘‘সেটা স্বাভাবিক। কী রকম ভাবে আমাদের মনোনয়ন জমা দিতে বাধা দেওয়া হয়েছে, সে তো দেখতেই পেয়েছেন। গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে তো অনেক বেশি প্রার্থীর প্রয়োজন। এই সন্ত্রাসের মধ্যে অত সংখ্যক মনোনয়ন জমা করানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু জেলা পরিষদে রাজ্য জুড়ে মোট আসন ৮২৫। তাই অধিকাংশ আসনে আমরা প্রার্থী দিতে পেরেছি।’’

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

আরও পড়ুন: সন্ত্রাসের বলি তারাই, ভোটের আগে নিহত ৭, দাবি শাসক দলের

তা হলে কি জেলা পরিষদ নিয়ে আলাদা কোনও ভাবনা নেই দলের? এ বার আর পুরোপুরি অস্বীকার করলেন না রাজ্য সভাপতি। বললেন, ‘‘দলের সর্বভারতীয় নেতৃত্বও তো ফলটা দেখতে চাইছেন। গ্রাম পঞ্চায়েতে বা পঞ্চায়েত সমিতিতে কী হল, সর্বভারতীয় নেতৃত্ব তা তো আর দেখবেন না। জেলা স্তরের দিকেই মূলত তাঁরা চোখ রাখবেন। ফলে জেলা পরিষদের লড়াইয়ের আলাদা গুরুত্ব একটা রয়েছে।’’

সর্বভারতীয় নেতৃত্বের প্রতিনিধি হিসেবে এ রাজ্যে আপাতত রয়েছেল কৈলাস বিজয়বর্গীয়। পর্যবেক্ষক কৈলাস অবশ্য রণকৌশল নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে নারাজ। কোন স্তরের লড়াইয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব? সরাসরি জবাব এড়িয়ে গিয়ে কৈলাস বলছেন, ‘‘সব স্তরকেই গুরুত্ব দিচ্ছি। কিন্তু গ্রাম পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে অনেক জায়গাতেই তো প্রার্থী দিতে দেয়নি। যাঁরা মনোনয়ন জমা দিতে পেরেছিলেন, তাঁদের প্রত্যাহারে বাধ্য করেছে। জেলা পরিষদ স্তরে অতটা পারেনি।’’

আরও পড়ুন: ১৪ শতাংশ বুথে নজরদারি

কৈলাস-দিলীপ, দু’জনের মন্তব্যেই স্পষ্ট, বাংলার পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিকে বিশেষ নজর রয়েছে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের। কিন্তু গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতি ছেড়ে জেলা পরিষদ আসনগুলির দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার কারণ কী?

গ্রাম পঞ্চায়েতের আসনে ভোটের ফলাফল সব সময় দলীয় প্রতীকের উপরে নির্ভর করে না। ক্ষুদ্রতম পরিসরের ভোট। তাই প্রার্থী কে, সে প্রশ্নও অন্ত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যে কোনও দলই চেষ্টা করে এমন কোনও প্রার্থী খুঁজে বার করতে, যাঁর বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট বুথের বাসিন্দাদের অসন্তোষ থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম। সে দৌড়ে শাসক দলই এগিয়ে থাকে, কারণ ভাল প্রার্থী হিসেবে যাঁদের নাম ভোটের আগে গ্রামে ভেসে ওঠে, তাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শাসক দলের কাছ থেকে প্রস্তাব পেলে আর অন্য দিকে ঝুঁকতে চান না।

পঞ্চায়েত সমিতির আসনগুলি অপেক্ষাকৃত বড় এলাকা জুড়ে থাকে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও প্রার্থীর মুখ বা ভাবমূর্তি কিছুটা প্রভাব ফেলে।

পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলা পরিষদ হল এমন একটি স্তর, যে স্তরের প্রার্থীকে ব্যক্তিগত ভাবে চেনা অধিকাংশের পক্ষেই সম্ভব হয় না। কারণ কোনও ব্লকে দু’টি, কোথাও তিনটি করে জেলা পরিষদ আসন থাকে। এলাকা হয় অনেকটা বড়। ফলে জেলা পরিষদের ভোটের ক্ষেত্রে সিংহভাগ ভোটারই প্রতীক দেখে ভোট দেন, প্রার্থীর নাম দেখে নয়।

প্রতীকের জোরে বা নিজেদের রাজনীতির জোরে বাংলায় কতটা ভোট টানতে পারছে দল, বিজেপি-র সর্বভারতীয় নেতৃত্ব এখন সেটাই পরখ করে নিতে চান। তাই জেলা পরিষদের উপরেই সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে বলে বিজেপি সূত্রের খবর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE