নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। —ফাইল চিত্র।
সত্যিই লালবাতির নিষেধ ছিল না। তবু উৎসবের দিনের জমজমাট নন্দন-চত্বর, সান্তা টুপিধারী থিকথিকে ভিড়টাও সব ভুলে কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে থাকল।
মঙ্গলবার, বড়দিনের সন্ধেয় এক কবির শবদেহবাহী গাড়িটা তখন রবীন্দ্র সদন থেকে বাংলা আকাদেমি ভবনের দিকে এগোচ্ছে। আশ্চর্য সমাপতনে বাঙালির ‘যিশু দিবস’-ই ‘কলকাতার যিশু’-র কবির প্রয়াণ-দিবস হিসেবে লেখা থাকল।
৯৪ বছরের বর্ষীয়ান কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর শরীরটা যে ভাল যাচ্ছে না, তা নিয়ে সোমবার বিকেলেই নবান্নে আক্ষেপ করছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার কিছু ক্ষণ আগেই মুকুন্দপুরের বেসরকারি হাসপাতালে প্রবীণ কবির কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ দিন সকালেই হাসপাতালের চিকিৎসকদের কাছে কার্যত পরিষ্কার হয়ে যায়, পরিস্থিতি খুব একটা ভাল নয়! খবর দেওয়া হয় কবির পরিজনেদের। তাঁরা পৌঁছনোর কিছু ক্ষণ বাদেই সব শেষ! দুপুরে সাড়ে ১২টা নাগাদ কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পুত্র কৃষ্ণরূপ চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘নিউমোনিয়া, বুকে জল জমা, কিডনির কষ্ট— অনেক কিছু লেগেই ছিল। তবে আসল সমস্যা বয়স! কয়েক বার অসুস্থ হয়ে সামলে নিয়েছিলেন। এ বার আর হল না।’’
দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের পরে নীরেনবাবু— পরপর দু’দিন বাংলা সংস্কৃতি জগতের দুই নক্ষত্রপতন! রাত সাড়ে আটটা নাগাদ নিমতলা শ্মশানে ২১টি গান-স্যালুটের পরে কবির শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। তার আগে বিকেলে দেহ রবীন্দ্র সদনে রাখা হয়েছিল। কবির বড় মেয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সোনালী বন্দ্যোপাধ্যায়, জামাই শিল্পসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়দের তখন সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সাহিত্য জগতের এই মহীরূহ পতনে শোক প্রকাশ করেন তিনি। বাংলা আকাদেমি হয়ে বাঙুরের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় কবির মরদেহ।
সর্বত্র মন্ত্রী-নেতা থেকে গুণিজনের ভিড়। শঙ্খ ঘোষ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শাঁওলি মিত্র, জয় গোস্বামী— অজস্র চেনা মুখ। কিন্তু সকলেই কবির অনুজপ্রতিম! নীরেনবাবুর বিরামহীন কলম এই কিছু দিন আগেও উত্তরবঙ্গ থেকে প্রকাশিত একটি স্বল্পখ্যাত পুজো সংখ্যার জন্য কয়েকটি অমোঘ লাইন লিখেছিল! তাতে, একটি সঙ্গীহীন একলা ঘুড়ির কথা বলা! আশপাশের বিভিন্ন ঘুড়ির কাটা পড়ার মধ্যে যে তখনও
আকাশে ভাসছে!
এ বছরের গোড়ায় স্ত্রীবিয়োগের পরে নীরেনবাবু হারিয়েছিলেন তাঁর দীর্ঘদিনের সুহৃদ, আনন্দবাজারে সহকর্মী সাহিত্যিক-সম্পাদক রমাপদ চৌধুরীকে। কবির ছোট জামাই, অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার বলছিলেন, ‘‘তীব্র কষ্ট পেলেও ওঁর ইতিবাচক মনটিকে তবু জিইয়ে রেখেছিলেন।’’ নীরেনবাবু বলতেন, এখনও সূর্যোদয় দেখলে মনটা ভাল হয়ে যায়। কষ্ট হয়, সূর্যাস্তের সামনে। কবিতা লেখাও থামাননি শেষ পর্যন্ত। ‘বইমেলা’ নিয়ে একটি ছড়া লিখেছেন গত মাসে। তাঁর সদ্যপ্রকাশিত ষষ্ঠ কবিতাসংগ্রহের পাণ্ডুলিপির কিছু সংশোধনেও ব্যস্ত ছিলেন তিনি। গত ৯ ডিসেম্বরে হাসপাতালে ভর্তি হতে হল। এর পরেও ছোট মেয়ে শিউলিকে নির্দেশ দিয়েছেন, কাকে তাঁর ‘কবিতার ক্লাস’ বইয়ের অমুক অংশটি পাঠিয়ে দিতে হবে!
এ দিন বিকেলে রবীন্দ্র সদন গমগম করছিল কবির চিরপরিচিত কণ্ঠস্বরে। নীরেনবাবুর স্পষ্ট কাটা-কাটা উচ্চারণে শোনা যাচ্ছিল, তাঁর চেনা কবিতার আবৃত্তি। ‘‘আমার খুব প্রিয় ‘কলকাতার যিশু’, ‘চতুর্থ সন্তান’ বা ‘হ্যালো দমদম’! সহজ করে সাধারণের মুখের ভাষায় লিখতেন। বিরল কবি, যাঁর লাইন কবিতার সিরিয়াস পাঠক ছাড়াও সাধারণের মুখে-মুখে ঘুরছে।’’— বললেন জয় গোস্বামী। মুখ্যমন্ত্রীর শোকবার্তা থেকে সোশ্যাল মিডিয়ার অনুভবে অবশ্য উঠে এসেছে আনন্দমেলা-র প্রথম সম্পাদক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কথাও। তাঁর অনুবাদের গুণেই ফরাসি কমিকসের টিনটিন-হ্যাডক-প্রফেসর ক্যালকুলাসরা বাঙালির ঘরের লোক! বহু বাঙালির ছোট থেকে বড়বেলা, কী ভাবে এক প্রিয় কবি-লেখকের কাছে গচ্ছিত, এই বড়দিন তাও ক্ষণে ক্ষণে মনে করিয়ে দিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy