Advertisement
E-Paper

আত্মীয় পরিচয়ে আনাগোনা বেড়েছে বহিরাগতদের, পুলিশ কেন ধরছে না, প্রশ্ন এলাকাবাসীর

১৯ মে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক হিংসা শুরু হয়েছিল তা কোনও অদৃশ্য হাতের ছোঁয়ায় দুই গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের সংঘর্ষে পরিণত হয়। সেই হিংসার আগুনেই এখনও জ্বলছে গোটা এলাকা।

সিজার মণ্ডল

শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৯ ২৩:১১
কাঁকিনাড়া-ভাটপাড়ার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তৎপরতা। —নিজস্ব চিত্র

কাঁকিনাড়া-ভাটপাড়ার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তৎপরতা। —নিজস্ব চিত্র

তুষের আগুনের মত গত এক মাসের বেশি সময় ধরে অশান্তির আগুনটা জ্বালিয়ে রাখার জন্য দায়ী কে? বৃহস্পতিবারের হিংসার পর সেই উত্তরই খুঁজছেন কাঁকিনাড়া, জগদ্দল এবং ভাটপাড়ার বাসিন্দারা।

বৃহস্পতিবার যে কাছারিপাড়া রোডে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় রামলাল সাউ এবং ধর্মবীর সাউয়ের, তার ঠিক উল্টোদিকেই কাছারিপাড়া বাজার। আগের ভাটপাড়া ফাঁড়ি, বর্তমানে থানা থেকে মাত্র একশ মিটারের মধ্যে এই বাজার এলাকার বড় ‘মার্কেট’ হিসাবে পরিচিত। জামাকাপড়ের দোকান থেকে শুরু করে সোনার দোকান বা বৈদ্যুতিন সামগ্রী সমস্ত কিছুর দোকান মিলিয়ে কয়েকশো দোকানঘর।

এই বাজারেই দোকান আছে রাজীব চৌধুরীর। শুক্রবার দুপুরে বাজারের বিভিন্ন অংশে ভাঙচুর-লুঠ হওয়া দোকানঘর দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘‘গত একমাসে ক’দিন দোকান খুলতে পেরেছি গুনে বলে দিতে পারব। দোকান খুলতে পারলেও লাভ নেই। এই অশান্তির চোটে খরিদ্দার নেই।’’ একই অভিজ্ঞতা তাঁর মতো আরও অনেক ব্যবসায়ীর। তাঁদেরই একজন বলছিলেন, প্রতি বছর ঈদের আগে তাঁদের ভাল ব্যবসা হয়। এবার তা শূন্যে নেমে এসেছে। শুনসান বাজারে রাতের অন্ধকারে সিঁদ কাটে চোরেরা। দিনের বেলায় টহল দেয় পুলিশ।

এলাকার বাসিন্দা রাজেশ চৌধুরী বলেন, ‘‘১৯ মে ভাটপাড়া বিধানসভার নির্বাচনের দিন থেকে যে অশান্তি শুরু হয়েছে, তা চলছে এখনও।’’ ওই দিন থেকে শুক্রবার পর্যন্ত একটা দিনও যায়নি, যে দিন এই এলাকায় প্রকাশ্যে বোমাবাজি হয়নি। গত এক মাসের হিংসায় প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচ জন। কিন্তু হিংসা থামার কোনও লক্ষণ নেই।

১৯ মে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক হিংসা শুরু হয়েছিল তা কোনও অদৃশ্য হাতের ছোঁয়ায় দুই গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের সংঘর্ষে পরিণত হয়। সেই হিংসার আগুনেই এখনও জ্বলছে গোটা এলাকা।

ব্যারাকপুর স্টেশনের পাশ থেকে শুরু হওয়া ঘোষপাড়া রোড পলতা, ইছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরির পাশ দিয়ে গিয়ে শ্যামনগর জগদ্দল হয়ে পৌঁছেছে কাঁকিনাড়া। ডানদিকে ঘুরে সেই রাস্তাই ভাটপাড়া থানার পাশ দিয়ে রেল ব্রি়জ টপকে চলে গিয়েছে প্রাচীন ভট্টপল্লী বা ভাটপাড়ার দিকে। হুগলি নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা চটকলের কাজ নিয়ে এখানে বসবাস শুরু করেন বিহার উত্তর প্রদেশের দুই সম্প্রদায়ের হিন্দিভাষী মানুষ। এলাকার বাসিন্দারা স্বীকার করেন, কারণে অকারণে অশান্তি এর আগেও হয়েছে। কিন্তু কোনও অশান্তিই এতদিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

আরও পড়ুন: ভাটপাড়ায় দুই মৃতদেহ রাস্তায় নামিয়ে বিক্ষোভ, নতুন করে উত্তেজনা, ইট, লাঠি, কাঁদানে গ্যাস

দিলীপ সাউয়ের বাড়ি কাছাড়ি পাড়ার কাছেই। পেশায় রিলায়েন্স জুটমিলের কর্মী দিলীপ বলেন, ‘‘১৯ মে থেকে ২২ মে পর্যন্ত গোটা এলাকায় প্রকাশ্যে দাপিয়ে বেড়ায় একদল দুস্কৃতী। তারা বাড়িতে বাড়িতে ভাঙচুর করে, আগুন ধরায়, অবাধে লুঠপাট করে। সেই দুস্কৃতীদের টার্গেট ছিল, যারা শিবির বদলে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন।” দিলীপের মতো এলাকার একটা বড় অংশের অভিযোগ, ওই সময়ে পুলিশ সেই আক্রমণ প্রতিহত করা দূরে থাক, উল্টে বিনা কারণে পাকড়াও করেছে বিজেপি সমর্থকদের।

তাঁদের দাবি, ২৩ মে নির্বাচনের ফল ঘোষণার কয়েকদিন পর থেকে পাল্টা প্রতিরোধে নামে বিজেপি কর্মী সমর্থকরা। নির্বাচনের ফলাফল থেকে ততক্ষণে পরিষ্কার অর্জুন সিংহের হাত ধরে গোটা এলাকার রাজনৈতিক ক্ষমতার দখল নিয়েছে বিজেপি।

ভাটপাড়ার কয়েকশো বছরের বাসিন্দা ভট্টাচার্য পরিবারের প্রবীণ সদস্য রমাকান্ত বলেন, ‘‘এর পর থেকেই দ্রুত তৃণমূল বনাম বিজেপির সংঘর্ষ রাজনীতি ছাড়িয়ে বেশি হয়ে ওঠে দুই সম্প্রদায়ের লড়াই।” কিন্তু অভিযোগ, তার পরেও তৎপর হয়নি পুলিশ। নাম কা ওয়াস্তে কিছু ধরপাকড় হলেও, ঈদের ঠিক আগেই জেল থেকে আকস্মিক ভাবে ছাড়া পেয়ে এলাকায় ঢোকে রাজুয়ার মত কুখ্যাত দুষ্কৃতী। একই ভাবে যারা একসময় পুলিশের ভয়ে এলাকা ছাড়া হয়ে গিয়েছিল, সে রকম আরও কিছু কুখ্যাত ক্রিমিনালকে এ বার দেখা যায় পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে ঘুরে বেড়াতে। প্রকাশ্যে শুরু হয় লুঠপাট।

এলাকায় ঘুরছেন বারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিংহ। —নিজস্ব চিত্র

আরও পডু়ন: ডানা ছাঁটা হল জ্যোতিপ্রিয়র, উত্তর ২৪ পরগনার সাংগঠনিক দায়িত্বে পাঁচ জন

ভাটপাড়া থানা পেরিয়ে একটু এগোলেই রিলায়েন্স জুটমিলের পাশে ১৯ নম্বর গলি। সেখানকার বাসিন্দা মহম্মদ আশফাক। জুম্মার নমাজ সেরে ফেরার পথে প্রবীণ আশফাক বলেন, ‘‘লুঠপাট করছে দু’পক্ষই।’’ তিনি কাছাড়িপাড়া বাজারের কয়েকটি দোকানের কথা বলে অভিযোগ করেন, ওই এলাকার মানুষ সব লুঠ করেছে। তিনি স্বীকার করেন, মিলের কুলি লাইনের বাসিন্দা অন্য পক্ষেরও অনেকের বাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। তাঁরা এলাকা ছাড়া। তিনি অস্বীকার করেননি, এলাকায় আত্মীয় পরিচয় দিয়ে আনাগোনা বেড়েছে অনেক অচেনা লোকজনদের। রাজেশ বা দিলীপের মতো তাঁরও অভিযোগ, ‘‘পুলিশ কি করছে? তাঁরা কেন বহিরাগতদের ধরছে না?”

রামবাবু এবং ধর্মবীরের মৃত্যুর পর সাংসদ অর্জুন সিংহ থেকে শুরু করে কাছারিপাড়া এলাকার প্রত্যেকের দাবি, পুলিশের গুলিতেই মারা গিয়েছেন দু’জন। অর্জুন বলেন, ‘‘তাঁদের কাছে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ রয়েছে এবং সেই তথ্য নিয়ে তাঁরা আদালতে যাবেন পুলিশের বিরুদ্ধে।’’

যাঁদের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, সেই পুলিশ কর্তাদের একাংশের বক্তব্য খুব পরিষ্কার। দীর্ঘদিন এই এলাকায় কাজ করা এক পুলিশ কর্তা বলেন, ‘‘দেখুন, এই অশান্তি রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া মিটবে না। আমাদের দোষ আছে মানি, কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা নিজেরা সংযত না হলে এই লড়াই থামবে না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘এ ধরনের সংঘর্ষ দ্রুত ছড়ায়। কিন্তু এখানে আশপাশের কোনও এলাকায় এই অশান্তি ছড়ায়নি। যা হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট জায়গাতেই। এর থেকেই স্পষ্ট, এই হিংসা খুব পরিকল্পিত, যেখানে রয়েছে রাজনৈতিক মস্তিস্ক। তাঁর মতোই অন্য এক আধিকারিক বলেন, ‘‘ভোটের পর চার জন কমিশনার এলেন এখানে এক মাসে।” তাঁর কথায়, ‘‘এক জন নিজের সদ্য পাওয়া রাজনৈতিক ক্ষমতা আরও বাড়াতে চাইছেন। অন্য পক্ষ চাইছে ক্ষমতার কেন্দ্রে কামড় মেরে সাংসদকে দুর্বল করতে। আর তাই তাঁদের কারও সদিচ্ছা নেই এই লড়াই থামানোর। দু’পক্ষই মনে করছেন যে তাঁরা এই মেরুকরণের রাজনীতি থেকে নিজেদের কব্জির জোর বাড়াচ্ছেন।”

শুক্রবার বিকেলে কমিশনারের দায়িত্ব নেওয়ার পর আটটা নাগাদ ভাটপাড়া থানায় পৌঁছন নতুন কমিশনার মনোজ বর্মা। তাঁর দিকে তাকিয়ে তাঁর অধস্তনদের একাংশ বলেন, ‘‘পুলিশের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। আমাদের বুকে বোমা পড়লে আমরাও গুলি চালাব। বোমার কোনও জাত নেই। সে যে পক্ষই ছুঁড়ুক না কেন।’’

Bhatpara Violence Bhatpara Kankinara Arjun Singh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy