Advertisement
E-Paper

কোটি টাকা খরচ করে ডেউচায় আস্ত জঙ্গল সরাচ্ছে প্রশাসন, মাটি বদলালেও মহুয়া-অর্জুনের সুঠাম ডাল মাতাচ্ছে সবুজ পাতা

আদিবাসী-সংখ্যালঘুদের জনপদে কয়লাখনির মতো প্রকল্প করতে গিয়ে সাবধানে এগোতে হয়েছে রাজ্য সরকারকে। বিক্ষোভ, বিদ্রোহ সামলে প্রকল্প করতে ‘প্যাকেজ’ দিয়েছে রাজ্য সরকার। তার পরেও যে সব খুব মসৃণ ভাবে চলেছে তা নয়।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০২৫ ০৮:৫৮
Birbhum District administration is relocating 980 trees in Deucha Panchami

ডেউচা পাঁচামিতে ক্রেনের সাহায্যে তোলা হচ্ছে গাছ। ছবি: জেলা প্রশাসন সূত্রে প্রাপ্ত।

জঙ্গলের জমি বদল! বীরভূমের মহম্মদবাজার ব্লকের ডেউচা পাঁচামিতে তৈরি হচ্ছে কয়লাখনি। ইতিমধ্যে সেই কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে। তার মধ্যেই প্রশাসনিক উদ্যোগে সরানো হচ্ছে আস্ত একটি জঙ্গল। যে জঙ্গলে সবমিলিয়ে রয়েছে ৯৮০টি পূর্ণবয়স্ক মহুয়া, মুরগা, শিরীষ এবং অর্জুন গাছ। যে জঙ্গলের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে স্থানীয়দের আবেগও। দেড় কোটি টাকারও বেশি অর্থ খরচ করে জঙ্গলের ‘পুনর্বাসন’ ঘটাচ্ছে বীরভূম জেলা প্রশাসন।

ডেউচা পাঁচামিতে রয়েছে অনেকগুলি মৌজা। সেরকমই একটি মৌজার নাম চাঁদা। সেই চাঁদাতেই ছিল এই জঙ্গলটি। বীরভূমের জেলাশাসক বিধান রায় বলেন, ‘‘প্রথম ধাপে ১৮০টি গাছকে আমরা তুলে নিয়ে গিয়ে অন্যত্র বসিয়েছিলাম। শুক্রবার পর্যন্ত মোট ৫৪৬টি গাছকে সরানো হয়েছে। ধাপে ধাপে বাকিগুলিও হবে।’’ জেলাশাসক এ-ও জানিয়েছেন যে, প্রথম পর্বে যে ১৮০টি গাছকে তুলে নিয়ে গিয়ে এক কিলোমিটারের মধ্যে বসানো হয়েছিল, সেই সব গাছেরই ডালে এখন সবুজ পাতার সমাহার।

Birbhum District administration is relocating 980 trees in Deucha Panchami

সরিয়ে নিয়ে যাওয়া গাছগুলিকে অন্যত্র বসানোর কাজ চলছে। ছবি: জেলা প্রশাসন সূত্রে প্রাপ্ত।

আদিবাসী-সংখ্যালঘুদের জনপদে কয়লাখনির মতো প্রকল্প করতে গিয়ে সাবধানে এগোতে হয়েছে রাজ্য সরকারকে। বিক্ষোভ, বিদ্রোহ সামলে প্রকল্প করতে ‘প্যাকেজ’ দিয়েছে রাজ্য সরকার। তার পরেও যে সব খুব মসৃণ ভাবে চলেছে তা নয়। রাজনৈতিক বিক্ষোভের পাশাপাশি একাধিক মানবাধিকার, পরিবেশ সংগঠনও বিরোধিতায় নেমেছিল। নবান্নের এক কর্তার কথায়, ‘‘ডেউচা পাঁচামির বিষয়ে গোড়া থেকেই রাজ্য সরকার ‘ধীরে চলো’ নীতিতে এগিয়েছে। কারণ, জমির সঙ্গে জড়িত ভাবাবেগ কী, তার কী প্রতিক্রিয়া হয়, তা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে বেশি কেউ জানেন না।’’ উল্লেখ্য, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলনের সূত্রেই মমতার বাম বিদায়ের আন্দোলন নতুন মাত্রা পেয়েছিল। ওই জমিরক্ষা আন্দোলনের ফসল তুলেই তিনি মুখ্যমন্ত্রিত্ব পেয়েছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। যদিও তার সঙ্গে সিপিএমের দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন দশকের শেষদিকের ‘অপশাসন’-এর ইতিহাসও জুড়ে ছিল। ফলে ডেউচার কয়লাখনির জন্য সেখানকার আদি বাসিন্দাদের পুনর্বাসন দিতে হয়েছে রাজ্য প্রশাসনকে। শুধু বসতি নয়, জঙ্গলেরও পুনর্বাসন হচ্ছে ডেউচায়। সম্প্রতি রাজনৈতিক স্তরে অভিযোগ উঠেছিল, ডেউচায় গাছ সরাতে গিয়ে সেগুলিকে মেরে ফেলা হচ্ছে। তা-ও খারিজ করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন।

আদিবাসী মানুষের কাছে জঙ্গল এবং বিশেষ কিছু গাছের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। নির্দিষ্ট কিছু গাছ রয়েছে, যা তাঁদের কাছে পূজনীয়। স্থানীয়দেরই দাবি ছিল, জঙ্গল রক্ষা করতে হবে। অতঃপর জেলা প্রশাসনের তরফে ডাকা হয় ‘গ্লোবাল টেন্ডার’। সেই দরপত্রের ভিত্তিতেই একটি বেসরকারি সংস্থাকে ওই কাজের দায়িত্ব দিয়েছে প্রশাসন। দু’জন বিশেষজ্ঞকেও নিয়োগ করেছে তারা। গত দেড় মাস ধরে জঙ্গল সরানোর কাজ চলছে ডেউচায়।

Birbhum District administration is relocating 980 trees in Deucha Panchami

মহুয়া গাছের ডালে এখন সবুজ পাতার সমাহার। ছবি: জেলা প্রশাসন সূত্রে প্রাপ্ত।

বীরভূম জেলা প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, প্রথমে প্রতিটি গাছের গোড়া সমেত তোলা হচ্ছে। তার পর তার ৭৫ শতাংশ শিকড় ছেঁটে ফেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অন্যত্র। কারণ, শিকড়ের পরিমাণ বেশি থাকলে গাছের খিদেও বেশি থাকে। তাই মূল-শিকড়ের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে করা হচ্ছে ‘হরমোন থেরাপি’। পাট দিয়ে মূলের জায়গায় তৈরি করা হচ্ছে ‘রুট বল’। তার পরে গর্ত খুঁড়ে, গোবর সার দিয়ে নতুন মাটিতে বসানো হচ্ছে সেই সমস্ত গাছ। খড় দিয়ে আরও একটি প্রক্রিয়া করা হচ্ছে। উদ্ভিদবিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলে ‘মালিঞ্চ’। গাছের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দিকও বদল হচ্ছে না। ধরা যাক একটি মহুয়া গাছ বেড়ে উঠেছে এমন ভাবে, যে তার পূর্বদিকের ডালটি মোটা, পশ্চিমের দিকের ডালটি সরু। যখন সেটিকে নতুন করে নতুন মাটিতে বসানো হচ্ছে, তখনও ওই বিষয়টিও খেয়াল রাখা হচ্ছে। জেলাশাসক বিধানের কথায়, ‘‘যে ভাবে বেড়ে উঠেছে, সে ভাবেই রাখা হচ্ছে।’’

রাজ্যে বামজমানায় শ্যামল চক্রবর্তী যখন পরিবহণমন্ত্রী ছিলেন, সেই সময়ে তিনি উল্টোডাঙা পর্যন্ত ট্রামলাইন সম্প্রসারণ করেছিলেন। সেই পর্বে কাঁকুড়গাছি থেকে উল্টোডাঙা পর্যন্ত রাস্তার মধ্যবর্তী বুলেভার্ডের প্রচুর গাছ অন্যত্র সরানো হয়েছিল। তবে ডেউচায় আস্ত একটি জঙ্গলকেই অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের এক কর্তা খানিক রসিকতা করে বলছিলেন, ‘‘লোকে জঙ্গল সাফারিতে যান। আর ডেউচায় জঙ্গলেরই সাফারি হচ্ছে!’’

Deucha Panchami Deucha Pachami Deucha Pachami Coal Mine Tree Relocating
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy