একে দেরি, তায় অবরোধ। নাকাল যাত্রীরা। শুক্রবার শ্যামনগর স্টেশনে সজল চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।
হাওড়া স্টেশনের প্রবীণ ঘড়িটির মতো কেউ হয়তো নেই শিয়ালদহে। তবে ওই স্টেশনেও বেশ বড় ডিজিটাল ঘড়ি আছে এবং প্রতিদিন অজস্র মানুষ তাতে সময় মিলিয়ে নেন। কিন্তু রেল সেই ঘড়ির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ট্রেন চালায়, এমন অপবাদ দিতে পারবে না কেউ!
ফল যা হওয়ার, তা-ই হচ্ছে। ঘড়ি চলছে সময় মেনে। ট্রেন কিন্তু ছুটছে সময়ের আদৌ তোয়াক্কা না-করে। খামখেয়ালে। রোজ রোজ ভুগছেন যাত্রীরা। কিন্তু তাঁদের ক্ষোভ যে গুমরোচ্ছিল, বোঝা গেল শুক্রবার।
লাগাতার অনিয়মিত ট্রেন চলাচলের প্রতিবাদে যাত্রীদের একাংশ সটান নেমে পড়লেন রেললাইনে। প্রায় দু’ঘণ্টার অবরোধে কার্যত গোটা দিনের ট্রেন চলাচলই বিপর্যস্ত হয়ে গেল শিয়ালদহ উত্তরে। বিকেল পর্যন্ত ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক না-হওয়ায় বিভিন্ন স্টেশনে হাজির হওয়া হাজার হাজার দর্শনার্থীর এ দিন প্রতিমা দর্শন করতে আসা হল না কলকাতায়।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকে কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী, অবরোধের বিপক্ষে সকলেই। শিয়ালদহের যাত্রীরাও যে পারতপক্ষে অবরোধ চান না, বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক দলের অবরোধ হটিয়ে তাঁরা তার প্রমাণ দিয়েছেন। তবু এ দিন অবরোধ হল কেন?
নিরুপায় হয়ে, জবাব আমযাত্রীর। তাঁদের অভিযোগ, সময় না-মানার ব্যাধিতে দীর্ঘদিন ধরে ভুগছে রেলের শিয়ালদহ শাখা। সেই রোগ সারানোর কোনও চেষ্টাই নেই কর্তাদের। বারবার বলা সত্ত্বেও ঠিক সময়ে ট্রেন চালানোর উদ্যোগ নেই। এ দিনও সকালে ট্রেন চলছিল প্রচণ্ড দেরিতে। বচ্ছরকার দিনে উৎসবে মেতে ওঠা মানুষ রেলের গয়ংগচ্ছ মনোভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তাই অবরোধ।
যাত্রীদের এই অভিযোগ সমর্থন করছেন রেলকর্মীদের একাংশও। তাঁদের বক্তব্য, এই ডিভিশনে কী ভাবে ট্রেন চলে, জেনারেল ম্যানেজার থেকে ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজার পর্যন্ত কেউই তার কোনও খোঁজ রাখার তাগিদ অনুভব করেন না। তাঁরা ‘স্বচ্ছ ভারত’ বা ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’র মতো রাজনৈতিক প্রকল্প রূপায়ণ নিয়েই ব্যস্ত। যাত্রীরা পরিষেবা পেলেন কি না, সেই বিষয়ে তাঁদের কোনও মাথাব্যথাই নেই।
ঠিক কী ঘটেছিল শুক্রবার?
এ দিন সকাল ১০টা নাগাদ একটি নৈহাটি লোকাল দেরিতে চলছিল। তার প্রতিবাদে বেলঘরিয়া স্টেশনে অবরোধ শুরু করেন এক দল যাত্রী।
কেন দেরি? রেলকর্তাদের বক্তব্য, বেলঘরিয়ার কাছে রেললাইনের একটি পয়েন্ট খারাপ হয়ে যাওয়ায় সিগন্যালে গোলমাল দেখা দেয়। সেই জন্য ওই সময় হাতে হাতে ‘পেপার ক্লিয়ারেন্স’ (কাগজে লিখে সিগন্যাল) দিয়ে ট্রেন চালানো হচ্ছিল। তাই ওই লাইনে ট্রেনের কিছুটা দেরি হয়েছে। যাত্রীরা এ কথা শুনতেই চাননি বলে রেলকর্তাদের অভিযোগ।
আর যাত্রীদের বক্তব্য, ছ’মাস ধরে এই লাইনে সকাল-সন্ধ্যা-রাত, সব সময়েই লোকাল ট্রেন চলছে অনিয়মিত ভাবে। ফলে ভিড়ের চাপে ট্রেনে পা রাখা দায়। কিন্তু রেলকর্তাদের কোনও হেলদোল নেই। বারবার আবেদন-নিবেদনের পরেও পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হয়নি। পুজোয় বাড়তি ভিড় হবে, জানা কথা। কিন্তু তার মোকাবিলায় আগাম কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। উৎসব উপলক্ষে রক্ষণাবেক্ষণে বাড়তি একটু নজর দিলে বিপত্তি এড়ানো যায়। দেখভাল ঠিকঠাক হলে সিগন্যালের সমস্যা আগেই ধরা পড়ত। যথাসময়ে সেটার সুরাহা হয়ে গেলে ট্রেনের দেরি এড়ানো যেত। তার বদলে দুর্গাষষ্ঠীতে অবরোধে নামতে হল যাত্রীদের।
ঘণ্টা দুয়েক অবরোধ চলার পরে, বেলা ১২টা নাগাদ বুঝিয়েসুজিয়ে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দেয় পুলিশ। তত ক্ষণে ওই শাখার সব লাইনে ট্রেন চলাচল বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছে। বিকেল ৪টে পর্যন্ত ট্রেন চলেছে অনিয়মিত। দুপুর-দুপুর কলকাতায় এসে প্রতিমা দেখে যাঁরা বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই স্টেশন থেকে বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
নিত্যদিনের এই দুর্ভোগ থেকে যাত্রীদের রেহাই মিলছে না কেন?
রেলকর্তাদের একাংশ বলছেন, পূর্ব রেলের ট্রেন চালানোর দায়িত্বে থাকা অফিসারেরা শিয়ালদহের এই ধারাবাহিক সমস্যাকে পাত্তাই দিতে চান না। অনিয়মিত ট্রেন চলাচলের কারণ হিসেবে লেভেল ক্রসিং বন্ধ করতে না-পারার কথা বলছেন ডিভিশনাল রেল ম্যানেজার বাসুদেব পণ্ডা। প্রয়োজনে আরপিএফ বসিয়ে লেভেল ক্রসিং বন্ধ করার দায়িত্ব তো রেলেরই। সেটা করা হচ্ছে না কেন? জবাব দেননি বাসুদেববাবু। ‘‘গোটা কুড়ি ট্রেন অনিয়মিত হতে পারে। বাকি সবই ট্রেনই চলে ঠিক ঠিক সময়ে,’’ দাবি ওই রেলকর্তার।
এই দাবি উড়িয়ে দিচ্ছেন রেলকর্মীদেরই একাংশ। তাঁরা জানাচ্ছেন, ব্যাধি তো একটা-আধটা নয়। অসুখ সর্বাঙ্গে। কখনও চালক নেই তো কখনও গার্ড নেই। কখনও যান্ত্রিক ত্রুটি তো কখনও একটু জোর হাওয়া বইতে না-বইতেই ছিঁড়ে পড়ছে ওভারহেড তার। সিগন্যাল-বিভ্রাটে ট্রেন থমকে যাচ্ছে মাঝেমধ্যেই। কিন্তু খাতায়-কলমে অঙ্কের গোঁজামিলে দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ৯৫ শতাংশ ট্রেনই সময়মতো চলছে। রেল বোর্ড বা পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজার জানতেও পারছেন না, আসলে কী ঘটছে শিয়ালদহ শাখায়।
অসুখ সারাতে গেলে কাউকে না-কাউকে যে এর দায়দায়িত্ব নিতে হবে, সেটা স্বীকার করে নিচ্ছেন অনেক রেলকর্তা। তাঁরা বলছেন, এই অসুখ সারাতে হলে দরকার কয়েক জন দক্ষ অফিসার। যাঁরা এখন রয়েছেন, তাঁরা ট্রেন চালানোর ব্যবস্থাটা চালিয়ে নিয়ে যেতে কতটা দক্ষ, সেই ব্যাপারে প্রশ্ন এবং সংশয় আছে রেলের অন্দরেই।
রেলের প্রবীণ ও বর্তমান অনেক কর্তার ব্যাখ্যা, শিয়ালদহের নিত্য গোলমালকে ত্রুটি বললে দায়ভাগ ঘাড়ে নিতে হবে। তাই দায়িত্বপ্রাপ্ত রেলকর্তারা মুখে কুলুপ এঁটেছেন। নিত্যদিনের রুটিনমাফিক নজরদারিও হচ্ছে না। আর প্রশাসন নীরব-নিষ্ক্রিয় থাকায় গা এলিয়ে দিয়েছে সকলেই।
রেলের নিয়মে ঠিকমতো ট্রেন চালানোর দায়িত্ব চিফ অপারেশন ম্যানেজার এবং ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজারের। ব্যর্থতার দায় কবুল করে তাঁরা পদত্যাগ করবেন না কেন, প্রশ্ন রেলকর্মীদের একাংশের।
‘‘আমি জেনারেল ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলব,’’ মুচকি হেসে বললেন পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy