Advertisement
E-Paper

ব্লু-ফিল্ম: তদন্তে নেমে পুলিশ দেখছে সল্টলেক হিমশৈলের চূড়া মাত্র

রাতের আপ বনগাঁ লোকাল। ঠাসা ভিড় মহিলা কামরায়। তারই মধ্যে সাদা কাগজের উপর কালো কালিতে ছাপা বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়ে সুনীতার (নাম পরিবর্তিত)। ‘ফিল্ম-সিরিয়ালে নতুন মুখ চাই। অভিনয় করতে চান? নামী ডিরেক্টরের কাছে অভিনয় শিখে ফিল্মে অভিনয় করুন। যোগাযোগ করুন ... নম্বরে।’ কিন্তু, এই বিজ্ঞাপনই যে এক দিন তাঁকে অন্য এক জালে জড়িয়ে ফেলবে তা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি তিনি।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৫ ১৬:১০

রাতের আপ বনগাঁ লোকাল। ঠাসা ভিড় মহিলা কামরায়। তারই মধ্যে সাদা কাগজের উপর কালো কালিতে ছাপা বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়ে সুনীতার (নাম পরিবর্তিত)। ‘ফিল্ম-সিরিয়ালে নতুন মুখ চাই। অভিনয় করতে চান? নামী ডিরেক্টরের কাছে অভিনয় শিখে ফিল্মে অভিনয় করুন। যোগাযোগ করুন ... নম্বরে।’ কিন্তু, এই বিজ্ঞাপনই যে এক দিন তাঁকে অন্য এক জালে জড়িয়ে ফেলবে তা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি তিনি।

ঠাকুরনগর থেকে সপ্তাহভর ওই তরুণী কাজের জন্য শহরে আসেন। সল্টলেকে একটা সংস্থায় টেলি কলার হিসেবে কাজ করেন। সাতসকালে বাড়ি থেকে বেরোতে হয়। ফিরতে ফিরতে সেই রাত। আর দূরত্বটাও তো কম নয়, প্রায় ৬৫ কিলোমিটার! তাঁর স্বামীও একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। সাধারণ গৃহবধূর জীবন চাননি বলেই কাজটা নিয়েছিলেন সুনীতা। আসলে, ছোটবেলা থেকেই তাঁর স্বপ্ন ছিল, সিনেমার অভিনেত্রী হবেন। তাই বিজ্ঞাপনটা দেখেই মোবাইলে সেফ করে রেখেছিলেন যোগাযোগের নম্বরটা। ওই রাতেই বাড়ি ফিরে মোবাইল থেকে যোগাযোগ করেন তিনি। বেশ কয়েকটা ধাপ পেরিয়ে কাজে যোগ দেন। কিন্তু, ব্লু-ফিল্ম করার অভিযোগে গত সোমবার সল্টলেক থেকে বিধাননগর পুলিশ সুনীতা-সহ ২৮ জনকে গ্রেফতার করে।

আশ্চর্যের আরও বাকি ছিল। পুলিশের কাছে সুনীতা জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে তাঁর কোনও অপরাধ বোধ নেই। কারণ এটা তাঁর পেশা।

আর এটাতেই চিন্তার ভাঁজ পড়েছে পুলিশ কর্তাদের কপালে। তাঁদের মতে, সল্টলেকে ‘ব্লু ফিল্ম’-এর শুটিং আসলে হিমশৈলের চূড়া মাত্র। শুধু এখানে নয়, কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলা মিলিয়ে প্রায় ১০০টি এমন ছোট ছোট শুটিং-ইউনিট জাল বিছিয়ে রেখেছে। তাদের সেই ‘ব্লু-ফিল্ম’ বিক্রি হয় বিদেশে। কম বাজেটের এই সব ঘরোয়া পর্ন-ছবির আন্তর্জাতিক বাজারে বিশাল চাহিদা। কাজেই ফিচার এবং টেলি ফিল্মের পাশাপাশি একটা সমান্তরাল ইন্ডাস্ট্রি চলছে গোটা রাজ্যে। আর সেই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন, সাদামাটা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরাও। বাদ যাচ্ছেন না সাধারণ পরিবারের গৃহবধূরাও। যেমন সুনীতা। তদন্তকারীদের একটা সূত্র জানাচ্ছে, টি-শার্ট, জিন্‌স পরা সুনীতার চেহারায় মফস্‌সলীয় কোনও ছাপ নেই। বরং তাঁকে দেখলে মনে হয়, শহরেরই কোনও প্রতিষ্ঠানের কর্মরত মহিলা।

কী ভাবে সুনীতাদের এই ইন্ডাস্ট্রিতে নিয়ে আসা হয়?

তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, মূলত তিন ভাবে ‘অভিনেতা-অভিনেত্রী’দের এই ধরনের কাজে নিয়ে আসা হয়। এক, ‘ফিল্ম-সিরিয়ালে নতুন মুখ চাই’ বলে বিজ্ঞাপন। দুই, যাঁরা এক বার এই পেশায় আসেন তাঁদের পরিচিতদের মধ্যে যাঁরা আগ্রহী তাঁদের ব্যবহার করা। তিন, এলাকাভিত্তিক ভাবে ‘এজেন্ট’ নিয়োগ করে ‘টোপ ফেলে’ ছেলেমেয়েদের এই কাজে নিয়ে আসা। যেমন বিজ্ঞাপন দেখে এসেছিলেন সুনীতা।

এই সংক্রান্ত আরও খবর: কলকাতা, সল্টলেকে ব্লু ফিল্ম করতে আসছেন কলেজছাত্রী, গৃহবধূরা!

কী ভাবে?

তদন্তকারীদের তিনি জানিয়েছেন, প্রথম বার ফোন করার কয়েক দিন পর তাঁকে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডেকে পাঠানো হয়। ইন্টারভিউ শেষে ফোটো প্রোফাইল করানো হয় তাঁর। এরও দিন তিনেক পরে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়। নিজেকে ছবির পরিচালক বলে পরিচয় দিয়ে সেই ভদ্রলোক জানান, গোটা কয়েক শর্ট ফিল্মে অভিনয় করার পর সুনীতা ফিচার ফিল্মে সুযোগ পাবেন। আর এই সব স্বল্প দৈর্ঘের ছবির শুটিং হবে সল্টলেকে। ফিল্মে কোন ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে তাঁকে? জবাব মেলে, ছোট ছোট গল্পের উপর ভিত্তি করে মূলত ‘বোল্ড’ প্রেমের দৃশ্য নির্ভর তৈরি হবে। মূল চরিত্রেই অভিনয় করবেন সুনীতা। ছোট ছোট সংলাপও থাকবে তাঁর মুখে। পুলিশের কাছে সুনীতা বলেন, ‘‘আমি কোনও হার্ডকোর পর্ন ছবিতে কাজ করিনি। ক্যামেরার সামনে শরীরের কোনও গোপন অঙ্গ তুলে ধরিনি।’’ তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, যে বিয়েবাড়ি ভাড়া করে ব্লু-ফিল্মের শুটিং চলছিল সেখান থেকে গোটা পঞ্চাশেক ভিডিও ক্লিপ উদ্ধার হয়েছে। তার ভেতর কী ধরনের ভিডিও আছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে, সল্টলেকের ওই ইউনিট এখনও পর্যন্ত যে ভিডিওগুলি ওয়েবসাইটে আপলোড করেছে তা মূলত সফ্‌ট-পর্ন বলে পুলিশের দাবি। ইন্ডাস্ট্রির কাছে যা মূলত ‘মশালা মুভি’ নামেই পরিচিত।
বাকি অংশ পড়তে ২-এ ক্লিক করুন

শুধু গৃহবধূ নন, নানা পেশার ছেলেমেয়েরাই ব্লু-ফিল্মে কাজ করতে আসছেন বলে পুলিশের দাবি। সল্টলেক-কাণ্ডে যাঁরা গ্রেফতার হয়েছেন তাঁরা সেই অর্থে পরিচিত কেউ নন। এমনকী পরিচালক বলে যে তিন জন দাবি করেছেন, তাঁদেরও টলিউড ইন্ডাস্ট্রি চেনে না। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, কেরিয়ারের শুরুর দিকে টলিউডের মাটিতে কোনও ভাবেই পা রাখতে পারেননি এঁরা। পরে দিল্লির একটা ওয়েবসাইটের তরফে এমন ছবি বানানোর প্রস্তাব আসে। এর পরই ‘ফিল্ম-সিরিয়ালে নতুন মুখ চাই’ বলে বিজ্ঞাপন দিয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রী জোগাড়ের কাজ শুরু হয়। অভিনেত্রীদের প্রতি দিনের পারিশ্রমিক আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। অভিনেতাদের জন্য বরাদ্দ পারিশ্রমিক যদিও বেশ কম, এক থেকে দেড় হাজার টাকা মাত্র। পরিচালকদের দাবি, একটা ১০ মিনিটের পর্ন-ছবির জন্য সারা দিনের শুটিং যথেষ্ট। এমনকী, কোনও ভাল ক্যামেরারও প্রয়োজন নেই এই কাজে। গোটা ছবির জন্য বাজেট ৩৫ হাজার টাকা মতন। পরিচালকের জন্য বরাদ্দ ২০ হাজার টাকা। দিল্লির ওই ওয়েবসাইট কোম্পানি এই ভিডিও নিয়ে কী করে? পরিচালকদের দাবি, তারা বিদেশি বিভিন্ন পর্ন-ওয়েবসাইট কোম্পানির কাছে এই ভিডিওগুলি বিক্রি করে।

ইন্ডাস্ট্রি যখন সমান্তরাল, টাকাপয়সা লেনদেনের ব্যবস্থা যখন বিশ্বব্যাপী— তখন হিমশৈলের এই চূড়া দেখে চোখে সরষের ফুল দেখছে পুলিশ।

blue film sex rackets saltlake MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy