Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

চোর সন্দেহে গণপিটুনির বলি ফের এক যুবক

স্রেফ সন্দেহ। আর তার বশেই চোর ঠাওরে মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবককে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ উঠল। অসহিষ্ণুতার ছবি এ বার কোলাঘাটে।

নিহত সিরাজুলের শোকার্ত মা। — নিজস্ব চিত্র

নিহত সিরাজুলের শোকার্ত মা। — নিজস্ব চিত্র

আনন্দ মণ্ডল
কোলাঘাট শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৬ ০৩:৩৬
Share: Save:

স্রেফ সন্দেহ। আর তার বশেই চোর ঠাওরে মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবককে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ উঠল। অসহিষ্ণুতার ছবি এ বার কোলাঘাটে।

গত মঙ্গলবার রাতে কোলাঘাটের সাহাপুর গ্রামের এক হোসিয়ারি কারখানা চত্বরে সিরাজুল ইসলাম (২২) নামে ওই ভারসাম্যহীন যুবককে মোবাইল চোর সন্দেহে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ। কারখানার দুই মালিক ও চার কর্মীকে গ্রেফতারও হয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা এসপি অলোক রাজোরিয়া বলেন, ‘‘চোর সন্দেহে ওই যুবককে পিটিয়ে খুনের ঘটনায় ধৃত ৬ জনের ভূমিকা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঘটনায় আর কারা জড়িত তা-ও দেখা হচ্ছে।’’

কলকাতার ঠাকুরপুকুরে আম চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে অনিরুদ্ধ বিশ্বাসের মৃত্যুর ঘটনার রেশ এখনও থিতোয়নি। গত শনিবার মারধরে জখম ওই কলেজ ছাত্র মারা গিয়েছেন বুধবার। গত ৯ মে ডায়মন্ড হারবারের মন্দিরবাজারে ‘মোষ চোর’ অপবাদ দিয়ে মায়ের সামনেই পিটিয়ে আইটিআই পড়ুয়া কৌশিক পুরকাইতকে মেরে ফেলার স্মৃতিও বেশ টাটকা। মাস খানেক আগে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙায় চোর সন্দেহে গণধোলাইয়ে প্রাণ গিয়েছিল মনোরোগী এক যুবকের। গণপিটুনিতে মৃত্যুর সেই তালিকায় এ বার ঢুকে পড়ল কোলাঘাটও। তবে সিরাজুলের মৃত্যুর সঙ্গে বছর দুয়েক আগে কোরপান শাহ হত্যার মিল অনেক বেশি। মানসিক প্রতিবন্ধী যুবক কোরপানকে কলকাতার নীলরতন সরকার হাসপাতালের হস্টেলে মোবাইল চোর সন্দেহেই পিটিয়ে খুনের অভিযোগ উঠেছিল ২০১৪ সালের নভেম্বরে।

কোলাঘাট শহর লাগোয়া ছাতিন্দা গ্রামের বাসিন্দা সিরাজুল জন্ম থেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন। তাঁর বাবা লিয়াকত আলি রং মিস্ত্রি। এক ছেলে, দুই মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে সংসার। অভাবে ছেলের চিকিৎসা করাতে পারেননি তিনি। সিরাজুল পড়াশোনাও করেননি। বাড়ির লোক ও প্রতিবেশীরা জানালেন, মাঝেমধ্যেই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতেন ওই যুবক। নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত তাঁকে। তেমন ঘুরতে ঘুরতেই গত মঙ্গলবার রাতে ছাতিন্দা থেকে চার কিলোমিটার দূরে সাহাপুরের কারখানা চত্বরে পৌঁছে গিয়েছিলেন সিরাজুল। তিনি মাঝেমধ্যেই রাতে ফিরতেন না বলে পরিজনেরা খুব একটা উদ্বিগ্নও ছিলেন না। বুধবার সকালে লিয়াকত খবর পান সাহাপুরের কারখানার সামনে ছেলের দেহ মিলেছে। প্রথম েস খবর বিশ্বাস করেননি লিয়াকত। পরে কারখানায় গিয়ে দেখেন, মারা গিয়েছে তাঁরই ছেলে। প্রথমে অবশ্য গণপিটুনির বিষয়টি প্রকাশ্যে আসেনি। অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করেছিল পুলিশ। কিন্তু বুধবার বিকেলে ময়না-তদন্তের পরে জানা যায়, সিরাজুলের সারা শরীরে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন রয়েছে, যা বেধড়ক মারধরেরই প্রমাণ। এর পর নিহতের পরিজনেরা খুনের অভিযোগ দায়ের করেন। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, ওই কারখানার লোকজনই মোবাইল চোর সন্দেহে পিটিয়ে মেরেছে সিরাজুলকে। বুধবার রাতে ওই কারখানার দুই মালিক স্বপন ভৌমিক, ভোলানাথ মণ্ডল এবং চার কর্মী নিতাই মান্না, লক্ষ্মীকান্ত প্রধান, সুজন দাস ও হিমাংশু মান্নাকে গ্রেফতার করা হয়। ধৃতদের এ দিন তমলুক আদালতে হাজির করা হলে স্বপন, নিতাই ও হিমাংশুকে পাঁচ দিনের জন্য পুলিশ হেফাজতে পাঠান বিচারক। বাকি তিন জনের ১৪ দিন জেল হেফাজত হয়েছে।

পুরনো ওড়িশা ট্রাঙ্ক রোডের ধারে সাহাপুরের ওই হোসিয়ারি কারখানাটি বেশ পুরনো। এ দিন কারখানায় গিয়ে অবশ্য কারও দেখা পাওয়া গেল না। গেটেও ঝুলছে তালা। তবে পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, মাস খানেক ধরে মাঝেমধ্যেই ওই হোসিয়ারি কারখানার কর্মীদের মোবাইল চুরি যাচ্ছিল। তা নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন কর্মীরা। পুলিশ জানিয়েছে, মঙ্গলবার রাত তিনটে নাগাদ সিরাজুল কোনওভাবে ওই কারখানা চত্বরে ঢুকে পড়েছিলেন। অপরিচিত মুখ দেখে কারখানার একাংশ কর্মী সিরাজুলকেই চোর ঠাওরাতে দেরি করেননি। আর তার পরই শুরু হয় বেধড়ক মার। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার।

এ ভাবে পিটিয়ে মারার ঘটনায় ফুঁসছে গোটা এলাকা। সিরাজুলের নিজের গ্রাম ছাতিন্দা তো বটেই, সাহাপুরের বাসিন্দারাও ক্ষুব্ধ। স্থানীয় অমিত দাস, কুশ পট্টনায়েকরা বলেন, ‘‘ওই কারখানা থেকে মোবাইল চুরি যাচ্ছে বলে শুনছিলাম। তাই বলে শুধু সন্দেহের বশে এ ভাবে একটা ছেলেকে পিটিয়ে খুন কোনও ভাবে মানা যায় না।’’

সিরাজুলের বাড়িতে এ দিন শুধুই হাহাকার। অবিরাম কেঁদে চলেছেন মা তহরা বেগম। বাবা লিয়াকতের দৃষ্টিতে শূন্যতা। লিয়াকত বললেন, ‘‘ছেলেটা ছোট থেকেই খ্যাপাটে ছিল। মঙ্গলবার রাতে বাড়ি না ফেরায় তাই বিশেষ ভাবিনি। এরকম তো কতদিন হয়েছে। কিন্তু ও যে আর কোনও দিন ফিরবে না ভাবতে পারিনি।’’ এর পর ছেলেহারা বাবার দাবি, ‘‘যারা আমার ছেলেটার এমন পরিণতি করল, তারা যেন শাস্তি পায়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Theif Lynched Youth
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE