Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Sovandeb Chattopadhyay

Sovandeb Chattopadhyay: টানা আটের রেকর্ড নিয়েও ছুটে বেড়াচ্ছেন ‘বহিরাগত’

চেহারা টানটান করে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় জবাব দিচ্ছেন, ‘‘আমি কিন্তু কখনও ভোটে হারিনি। জিতেছি ৮ বার। এখানে ভোট ভিক্ষা করতে আসিনি।

খড়দহে ভোটপ্রচার শোভনদেবের। নিজস্ব চিত্র।

খড়দহে ভোটপ্রচার শোভনদেবের। নিজস্ব চিত্র।

সন্দীপন চক্রবর্তী
খড়দহ শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০২১ ০৭:৪১
Share: Save:

আপনাকে তো ভূ-পর্যটক বলতে হচ্ছে মশাই! কিংবা রাজনৈতিক পর্যটক!

পাতুলিয়া সরকারি আবাসনে এক মুঠো ভিড়ের সামনে মঞ্চ থেকে নেমে পোড় খাওয়া মাথায় এক বার হাত বুলিয়ে নিলেন মন্ত্রী মশাই। এক কালের বক্সিং করা হাতে টানটান করে নিলেন পরনের জহর কোট। তার পরে বললেন, ‘‘এখন যাতায়াত করছি। তবে আমি কিন্তু এখানে ফ্ল্যাট-ট্যাট কিছু নেব। মানুষ আমাকে পাবে।’’ ভবানীপুরে ৬ মাস আগে প্রচারের দৌড়ের মাঝেও যে হাসিটা সঙ্গী ছিল, এ বার যেন একটু স্মিত। একটু যেন টেনশনও সঙ্গে দৌড়চ্ছে?

চেহারা টানটান করে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় জবাব দিচ্ছেন, ‘‘আমি কিন্তু কখনও ভোটে হারিনি। জিতেছি ৮ বার। এখানে ভোট ভিক্ষা করতে আসিনি। ভিক্ষা নিয়ে লোকে চলে যায়, তাকে কেউ জিজ্ঞাসা করে না ভিক্ষার টাকায় তুমি কী করলে? আমি এখানে মানুষের কাছে ভোটটা ঋণ চাইছি! সুদে-আসলে ধার শোধ করে দিয়ে যাব!’’

হেমন্তের অকাল-ভোটে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীর জয়ের রেকর্ড নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু তাঁর অন্য রেকর্ডটাই পর্যটনের অনুষঙ্গ নিয়ে আসছে। শোভনদেবের ৮ বার জয়ের ইতিহাসের মধ্যে প্রথম দু’বার বারুইপুর, তার পরের পাঁচ বার রাসবিহারী এবং তারও পরে সদ্য ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্র আছে। নবম বারে ভবানীপুরের কাঁসারিপাড়ার বাসিন্দা এসে প্রার্থী হয়েছেন উত্তর ২৪ পরগনার খড়দহে। বিধানসভা ভোটের ফল ঘোষণার আগেই কোভিডে তৃণমূল প্রার্থী কাজল সিংহের মৃত্যুতে এই উপনির্বাচনে।

খড়দহের অচেনা গ্রামাঞ্চল এবং শহরের পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে শোভনদেব বোঝাচ্ছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় সেই ১৯৯৮ সালে বারুইপুরের বিধায়ক-পদে ইস্তফা দিয়ে উপনির্বাচনে জিতে তৃণমূলের প্রতীকে প্রথম বিধায়ক হয়েছিলেন। আবার তৃণমূল নেত্রীকে নন্দীগ্রামে ‘চক্রান্ত’ করে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে তাঁকে ভবানীপুর ছেড়ে দিয়ে নেত্রীর নির্দেশেই চলে এসেছেন খড়দহে। আবার একটা উপনির্বাচনে! কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত, মেরুকরণের চেনা চাপানউতোরের বাইরে খড়দহের এই লড়াই একটু আলাদা।

বিধানসভা ভোটে যা ছিল শোভনদেবের দলের অস্ত্র, তা-ই এখন হাতে তুলে নিয়েছে বিজেপি। বয়স, রাজনীতি বা অভিজ্ঞতায় শোভনদেবের চেয়ে বহু যোজন পিছিয়ে থাকা বিজেপি প্রার্থী জয় সাহার প্রচারে আবেদন করা হচ্ছে, ‘বহিরাগত’ নয়। বেছে নিন ‘ঘরের ছেলে’কে। অমরাবতীর নির্বাচনী কার্যালয়ের এক কুঠুরিতে বসে জয় বলছিলেন, ‘‘খড়দহের মানুষের কপালটা দেখুন! টানা ৩৪ বছর ধরে খড়দহের বিধায়কেরা কেউ খড়দহের বাসিন্দা নন। অসীম দাশগুপ্ত, অমিত মিত্রের পরে তাঁরা কাজলবাবুকে পেয়েছিলেন, যাঁকে এখানকার লোক এক কথায় চিনত। তাঁর অকাল মৃত্যুর পরে আবার ৩০ কিলোমিটার দূর থেকে প্রার্থী এসেছেন। শোভনবাবু অত্যন্ত সজ্জন, সৎ রাজনীতিক। কিন্তু এখানকার নন।’’ বিজেপি প্রার্থী সংযোজন করতে ভুলছেন না, ভারতের কোনও নাগরিকই দেশের কোথাও ‘বহিরাগত’ নন। কিন্তু ৬ মাস আগের ভোটে তৃণমূল যে হেতু ‘বহিরাগত’ বলে বিজেপিকে দাগিয়ে দিয়েছিল, এখন তাঁরা সুযোগ পেয়ে পাল্টা দিচ্ছেন!

শোভনদেবের মতো জয়ও অবশ্য ৬ মাস আগে খড়দহের নির্বাচনী ময়দানে ছিলেন না। ময়দান না ছেড়ে গিয়ে, ইভিএমে নাম অপরিবর্তিত থাকছে শুধু দেবজ্যোতি দাসের। বন্দিপুরে পরিক্রমা সেরে সিপিএমের তরুণ প্রার্থী বলছেন, ‘‘প্রতিটা এলাকা, প্রতিটা গ্রামে ৬ মাস ধরে পড়ে থেকেছি। মানুষ আমাকে চেনেন। এখন তাঁদের বলছি, এই উপনির্বাচনে তৃণমূলের সরকার বদলাবে না বা বিজেপিও প্রধান বিরোধী দল থেকে সরে যাবে না। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে ঠিক পথে রাখার জন্য বিধানসভায় যে কথাগুলো বলার দরকার, সেই কথা বলার সুযোগটা দিন।’’ তৃণমূল এবং বিজেপির প্রবল মেরুকরণের বাজারেও ৬ মাস আগের ভোটে দেবজ্যোতি খড়দহে প্রায় ২৭ হাজার ভোট (১৪.৭০%) পেয়েছিলেন। সেই ভোট ধরে রাখাই যে বিরাট চ্যালেঞ্জ, জানেন বাম নেতারা।

একই ভাবে বিজেপির সামনেও পরীক্ষা ৬ মাস আগের ৩৩.৬৭% থেকে ভোট কমতে না দেওয়া। প্রার্থী জয় অবশ্য বলে রাখছেন, ‘‘উপনির্বাচনে এমনিই ভোট দেওয়ার উৎসাহ কম থাকে। তার উপরে প্রচারেই আমাদের বার বার পুলিশ দিয়ে বাধা দিয়েছে তৃণমূল। ভোটের দিন উপযুক্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে নিরাপত্তার ব্যবস্থা যদি ঠিকমতো থাকে, তা হলে মানুষ হয়তো কিছুটা ভরসা পাবেন। ভিতরে ভিতরে তাঁরা তৈরি।’’

শিল্পাঞ্চলে তৃণমূলের সাংগঠনিক সভাপতি পার্থ ভৌমিক বা এলাকার নেতা সুকুর আলিরা এ সবে অবশ্যই আমল দিতে নারাজ। বিরোধীদের কথা অবলীলায় উড়িয়ে সুকুরের পাল্টা দাবি, ‘‘এ সব বলতে হয়, তাই বলছে। কাজলদা’র চেয়েও (২৮ হাজার) বেশি ভোটে তৃণমূল জিতবে। শোভনদা জিতে বসে আছেন!’’

তৃণমূল প্রার্থী তথা কৃষিমন্ত্রীর কনভয় ততক্ষণে দিনের কাজ সেরে ফিরতি পথ ধরছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার আধা-শহর থেকে দক্ষিণ কলকাতা হয়ে উত্তর ২৪ পরগনার শিল্পাঞ্চলে ভোট-দৌড়। বসে থাকার ফুরসত আর পাওয়া হল কই শোভনদেবের! ‘বার বার ৮ বার’-এর রেকর্ডের সঙ্গে ‘বহিরাগত’— লড়াই তো তাঁর নিজের সঙ্গে নিজেরই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sovandeb Chattopadhyay Khardaha by election
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE