ক্যালকাটা ক্লাব দ্য টেলিগ্রাফ জাতীয় বিতর্কের মঞ্চে প্রভাত পট্টনায়ক, অভিরূপ সরকার, জহর সরকার, সন্দীপ চট্টোপাধ্যায়, রুদ্র চট্টোপাধ্যায়, কৌশিক চট্টোপাধ্যায় এবং সঞ্জয় বারু। ছবি: রণজিৎ নন্দী
কোমর কষে বিতর্কেও একটি বিষয়ে সব বক্তা একমত। শনিবার সন্ধ্যায় ‘ক্যালকাটা ক্লাব দ্য টেলিগ্রাফ জাতীয় বিতর্ক’-এর আসরে ধনতন্ত্রের স্যাঙাত বা ক্রোনিদের রমরমায় কেউই দেশের ভাল অন্তত দেখতে পেলেন না। সভার মত, স্যাঙাতদের হাতেই ধ্বস্ত ধনতন্ত্র (ক্রোনিজ আর ব্রেকিং ক্যাপিটালিজম)-এর বিপক্ষে বলতে উঠে বাঙালি শিল্পোদ্যোগী রুদ্র চট্টোপাধ্যায় বা টাটা স্টিলের কর্তা কৌশিক চট্টোপাধ্যায়রা ধনতন্ত্রের সাবেক মূল্যবোধের কথা তুলেছিলেন। তাঁদের মতে, শাসকের স্যাঙাতগিরি করে সফল হওয়া যায় না।
রুদ্রের মতে, ‘‘অন্যায় সুবিধা নয়, তরুণ শিল্পোদ্যোগীদের মূলধন হল উদ্ভাবনী ক্ষমতাই। স্যাঙাতদের ‘ফ্রেন্ডস উইদ বেনিফিট’ বলা যায়।’’ কিন্তু এ বিতর্কে রুদ্র, কৌশিকদের শিবিরের প্রবীণ প্রতিযোগী রাজনৈতিক বিশ্লেষক সঞ্জয় বারু স্যাঙাতদের সঙ্গে এ বন্ধুত্বে দেশের ক্ষতির কথা বলতে দ্বিধা করেননি। এ দেশে শাসকের শীর্ষ ব্যক্তিত্বের ‘ঘনিষ্ঠ’ শিল্পপতির নামটিও উহ্য থাকেনি।
সঞ্জয় বারুর কথায়, ‘‘ধনতন্ত্রে পক্ষপাতিত্বের ছায়া আগেও ছিল। এ দেশে ধনতন্ত্রের কাঠামোয় ক্রোনি বা স্যাঙাতেরা আগেও লালিত হয়েছেন। কিন্তু এখন সমীকরণ আরও জটিল।’’ বারু বলেন, ‘‘জিডি বিড়লা লাইসেন্সের জন্য ইন্দিরার কাছে যেতেন। কিন্তু এখন ‘এ’ ‘এম’-এর কাছে যাচ্ছেন না উল্টোটা ঘটছে, আমরা জানি না। এই সম্পর্ক দেশের স্বার্থ মেনে হচ্ছে না।’’ প্রতিপক্ষের এই স্বীকারোক্তির ধরতাইটুকু ছুঁয়ে বিতর্কের শেষ কথাটা বলতে এসে প্রাক্তন আমলা তথা রাজ্যসভার তৃণমূল সাংসদ জহর সরকার সহজেই ছক্কা হাঁকিয়েছেন। ‘এ’ কিংবা ‘এম’-এর পরিচয়ের আড়ালটুকুও মুছে ফেলে তিনি বলেন, ‘‘২০১৪য় ৭ বিলিয়ন ডলারের মালিক আদানি কী ভাবে ২০১৯এর মধ্যে ১০৭ বিলিয়ন ডলারের মালিক হলেন। এটা কি স্বাভাবিক? সৎপথে এটা সম্ভব? ধনতন্ত্র পক্ষপাতশূন্য হয় না, ব্যাভিচারের উপাদানেও বিয়ে টেকে। কিন্তু এই ক্রোনিজমে বিয়েটাই টালমাটাল। স্যাঙাতগিরি ধনতন্ত্র ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা দুটোকেই নিকেশ করছে।’’ রাজ্যসভায় দীর্ঘ অপেক্ষা করেও এই বিষয়গুলি তোলার সুযোগ পাননি জহর। বিতর্কসভার সঞ্চালক স্নায়ুশল্য বিশারদ সন্দীপ চট্টোপাধ্যায় তাঁকে সরস ভঙ্গিতে সান্ত্বনা দিলেন।
সভার মতের পক্ষে দুই অর্থনীতিবিদ, অভিরূপ সরকার এবং জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়কও স্যাঙাতগিরির বীভৎস চেহারাই বেআব্রু করেন। অভিরূপের মতে, ‘‘স্যাঙাতগিরি লালন করতে গিয়ে সরকার তথ্য লোপাট বা নাগরিক সমাজের কণ্ঠরোধও করে। সংস্কৃতি বা ধর্মের দিকে সবার মনোযোগ কাড়ে। এটাও স্যাঙাততন্ত্রের চরিত্র।’’ প্রভাতও এ দিন সরাসরি রাফাল-চুক্তি ঘিরে অভিযোগ বা শ্রীলঙ্কায় আদানির বিরাট প্রকল্প প্রাপ্তির উদাহরণ দেন। বলেন, ‘‘শ্রীলঙ্কায় আদানির প্রকল্প ভারত-শ্রীলঙ্কা সম্পর্কের স্মারক বলে দেখা হচ্ছে। তাতে দেশের লাভ কই! এই স্যাঙাততন্ত্র আদতে নিওফ্যাশিজ়ম।’’
ভোটাভুটিতে অমীমাংসিতই থাকে বিতর্ক। বারুর আশঙ্কা, দেশের মুক্ত বাজার অর্থনীতির ফলে প্রতিযোগিতার খোলা হাওয়া তৈরি হয়েছিল। উঠে এসেছিল বহু আনকোরা শিল্প-গোষ্ঠী। আজকের স্যাঙাততন্ত্রে ফের গুটিকয়েকের মৌরসিপাট্টার দিন ফিরছে। বরং পরিস্থিতি আরও জটিল। সঞ্চালক সন্দীপ চট্টোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ, দেশের এখনকার অবস্থা হীরক রাজার দেশের মতো। ক্যালকাটা ক্লাবে সুভাষ বোস ইনস্টিটিউট অব হোটেল ম্যানেজমেন্ট নিবেদিত এই বিতর্ক-সভাটি পিয়ারলেস হাসপাতাল এবং বিকে রায় রিসার্চ সেন্টারের সহায়তায় সম্পন্ন হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy