বিচ্ছেদের মামলা চলাকালীন সন্তানের অভিভাবকত্ব, ভরণপোষণ ইত্যাদি বিষয়েও আদালতে যুযুধান হন স্বামী-স্ত্রী। বহু ক্ষেত্রে সন্তানকে বিবদমান স্বামী বা স্ত্রীর থেকে দূরে সরানোর অভিযোগও ওঠে। কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশ, এ বার থেকে সন্তানের অভিভাবকত্ব, শিক্ষা এবং ভরণপোষণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত না-হওয়া পর্যন্ত বিবাহবিচ্ছেদের নির্দেশ জারি করতে পারবে না নিম্ন আদালত। বিচ্ছেদের মামলা চলাকালীন দু’পক্ষ কোনও সমঝোতায় না-এলে ৬০ দিনের মধ্যে সন্তানের অভিভাবকত্ব সংক্রান্ত অন্তর্বর্তী নির্দেশিকা দিতে হবে আদালতকে।
দাম্পত্য কলহ এবং বিচ্ছেদের সময় সন্তানের কল্যাণ সংক্রান্ত বিষয়ে নির্দেশিকা জারি করেছে কলকাতা হাই কোর্টের রুল মেকিং কমিটি। সেই নির্দেশিকায় উপরোক্ত নির্দেশের পাশাপাশি সন্তানের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের কী কী অধিকার এবং কর্তব্য, তাও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি হাই কোর্টের বিদায়ী প্রধান বিচারপতি সৌমেন সেন ও বিচারপতি অপূর্ব সিংহরায়ের ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ, এই নির্দেশিকা মেনে চলতে হবে। হাই কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল জেলা আদালতগুলিতে নির্দেশিকা পাঠিয়ে দেবেন।
অনেকেরই পর্যবেক্ষণ, বিচ্ছেদের মামলা চলার সময় বাবা-মায়ের সংঘাতে টানাহ্যাঁচড়ার শিকার হয় সন্তান। বহু ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্কও নষ্ট হয়। এই নির্দেশিকা তৈরি করতে গিয়ে হাই কোর্টের রুল মেকিং কমিটির পর্যবেক্ষণ, ‘‘বিবাহবিচ্ছেদ বা দাম্পত্যের লড়াইয়ে অনেক সময়ই সন্তানদের শিখণ্ডী হিসাবে ব্যবহার করেন বাবা-মা। তার ফলে সন্তানেরা মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।...শিশুর সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে বেড়ে ওঠার সময় বাবা-মা ও পরিবারের ভালবাসা ও স্নেহ প্রয়োজন। সন্তানদের বেড়ে ওঠার উপযুক্ত পরিবেশের স্বার্থে অভিভাবকত্ব এবং তত্ত্বাবধানের সুনির্দিষ্ট কাঠামো ওগাইডলাইন জরুরি।’’
হাই কোর্টের এই নির্দেশিকায় কিছু ক্ষেত্রে সন্তানের দায়িত্ব (কাস্টডি) না-পাওয়া অভিভাবককেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে,বার্ষিক ছুটির সময় সন্তানকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার ক্ষেত্রে কাস্টডি না-পাওয়া অভিভাবকই প্রথম পরিকল্পনা করার সুযোগ পাবেন। এ ছাড়াও, সপ্তাহে কাজের দিন, সপ্তাহান্তে ছুটি এবং সাধারণ ছুটির দিনেও সন্তানকে কাছে না-পাওয়া অভিভাবক নির্দিষ্ট সময় সাক্ষাৎ ও সময় কাটানোর সুযোগ পাবেন।দিনে অন্তত একবার ফোনেও সন্তানের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেওয়ারকথা বলা হয়েছে। সন্তানের থেকে দূরে থাকা অভিভাবককে দেখাকরতে না-দিলে এবং সন্তানকে দূরে সরিয়ে নিলে অভিভাবকত্ব বদল করার এবং প্রয়োজনে জরিমানাও করার কথাও নির্দেশিকায় বলাহয়েছে। এ-ও বলা হয়েছে যে সন্তানের সঙ্গে দেখা করতে বাধা পেলেওতার ভরণপোষণের খরচ বন্ধ করা যাবে না।
নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, সন্তানের থেকে দূরে থাকা অভিভাবককে না-জানিয়ে এবং লিখিত অনুমতি না-নিয়ে অন্য অভিভাবক সন্তানের স্কুল বা নাম-পদবি বদল করতে পারবেন না। সন্তানের কল্যাণে মামলার বিবাদ দূরে রেখে যৌথ কার্যকলাপের আয়োজন করার কথাও বলেছে হাই কোর্টের কমিটি। সন্তান এবং বাবা-মায়ের জন্মদিন কী ভাবে কাটবে, সে কথাও নির্দেশিকায় উল্লেখ করেছে কমিটি। বাবা-মা, দু’জনকেই যাতে সন্তান পায়, সেই কারণে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দু’জনের কাছে থাকার কথাও জানানো হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে আদালত নিযুক্ত পর্যবেক্ষকের ভূমিকা, বাবা-মায়ের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ইত্যাদির উপরেও এই নির্দেশিকায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
নির্দেশিকায় এ-ও বলা হয়েছে যে বিচ্ছেদের পর বাবা-মা ফের বিয়ে করলে বা সঙ্গী নিলেসন্তানকে সেই সঙ্গীকে বাবা অথবা মা ডাকতে শেখানো যাবে না। সেই সঙ্গীও যাতে সন্তানের সঙ্গে তারজন্মদাত্রী বাবা-মায়ের সম্পর্কে নাক না-গলান, তা নিশ্চিত করতেহবে। বাবা-মা নতুন করে সংসার পাতলে সেই পরিবারে সন্তানকে ধীরে ধীরে মানিয়ে নেওয়ার সুযোগদিতে হবে।
আদালত সূত্রের খবর, বিবাহবিচ্ছেদ এবং দাম্পত্য কলহের ঘটনায় সন্তানদের ক্ষতি আটকাতে এবং অভিভাবকত্ব, আশ্রয়, নিরাপত্তা, বিকাশ ও তত্ত্বাবধানের বিষয়ে নির্দিষ্ট নির্দেশিকা চেয়ে ২০২১ সালে কলকাতা হাই কোর্টে মামলা করে ছিলেন রাতুল রায় নামে এক চিকিৎসক। ২০২২ সালে মামলায় যুক্ত হয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সেই মামলায় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব হাই কোর্টের ‘রুল মেকিং কমিটি’-কে নির্দেশিকার কাঠামো গঠন করার নির্দেশ দেন। তার পরে রাজ্যের নিম্ন আদালতের বিচারক, মামলাকারীদের আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করে এবং প্রয়োজনীয় তথ্যের বিবেচনা করে ২০২৪ সালে সেই খসড়া নির্দেশিকা পেশকরেছিল কমিটি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)