নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাটে মিলেছিল টাকার পাহাড়। এ বার আদালতে নথি পেশ করে সিবিআই দাবি করেছে, প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতিতে কোটি কোটি টাকা জমা হত শাসক দলের প্রাক্তন যুব নেতা কুন্তল ঘোষের নিউ টাউনের ফ্ল্যাটেও। আর ওই বিপুল নোট গোনার জন্য রাখা
ছিল যন্ত্র।
সম্প্রতি বিচার ভবনের বিশেষ আদালতে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে কালীঘাটের কাকু, শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অরুণ হাজরা নামে এক ‘মিডলম্যানে’র বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দিয়েছে সিবিআই। সেই সঙ্গে কয়েক হাজার পাতার নথির সঙ্গে একাধিক সাক্ষীর গোপন জবানবন্দির বয়ানও জমা দিয়েছে। জানানো হয়েছে, বিচারকের সামনে ওই সাক্ষীরা গোপন জবানবন্দি দিয়েছেন। কোনও চাপের কাছে মাথা নত না করে, ওই জবানবন্দি দেওয়া হচ্ছে বলেও বিচারককে জানিয়েছেন তাঁরা। ওই সব সাক্ষীর গোপন জবানবন্দি আদালতগ্রাহ্য প্রমাণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে বলে দাবি তদন্তকারীদের। আইন অনুযায়ী গোপন জবানবন্দি আদালতগ্রাহ্য ও স্বীকৃত তথ্যপ্রমাণ বলে দাবি সিবিআইয়ের।
আদালত সূত্রের খবর, কুন্তল এবং শান্তনুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা এবং কুন্তলের অফিসের কর্মচারীরাও গোপন জবানবন্দি দিয়েছেন। সিবিআইয়ের জমা দেওয়া নথি অনুসারে, ওই সব সাক্ষী গোপন জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে বিএলএড এবং ডিএলএড বেসরকারি কলেজের মাধ্যমে ২০১৪ সালের টেট অনুত্তীর্ণ অযোগ্য প্রার্থীদের চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে কোটি কোটি টাকা তোলা হয়েছিল এবং তা কুন্তল ও শান্তনু মারফত জমা হয়েছিল সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রের বেহালার বাড়ি, লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের অফিসে।
সিবিআইয়ের জমা দেওয়া নথি অনুযায়ী, এক সাক্ষী জানান, তিনি হুগলির বলাগড়ের বাসিন্দা। অভিযোগ, তাঁকে একটি বেসরকারি কলেজের অংশীদার করা হবে বলে কুন্তল কয়েক লক্ষ টাকা নিলেও অংশীদার করেননি। টাকাও ফেরত দেননি। ওই টাকা ফেরত নেওয়ার জন্য কুন্তলের নিউ টাউনের ফ্ল্যাটে যাতায়াত করতেন তিনি। কয়েক দিন থেকেও ছিলেন ওই ফ্ল্যাটে। ওই সময় নানা জায়গা থেকে নগদ টাকা আসত। ওই সব টাকা যন্ত্রে গোনার পর খবরের কাগজে মুড়িয়ে সুজয়কৃষ্ণের কাছে নিয়ে যাওয়া হত। নথি অনুযায়ী ওই সাক্ষী জানান, যে তিনিও বেশ কয়েক বার সুজয়কৃষ্ণের কাছে গিয়েছিলেন এবং কুন্তলের নির্দেশমতো বেশ কয়েক জন অযোগ্য প্রার্থীর কাছ থেকে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা নিয়ে কুন্তলকে দিয়েওছিলেন। কিন্তু তাঁর কোনও প্রার্থীর চাকরি হয়নি। টাকাও ফেরত পাওয়া যায়নি।
বলাগড়ের বাসিন্দা এক পঞ্চায়েত কর্তা গোপন জবানবন্দির বয়ানে জানিয়েছেন, শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় হুগলিতে শাসক দলের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। তাঁর বাড়ির দুটি ঘর তিনি শান্তনুকে রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবে দিয়েছিলেন। এরপর তাঁর কাছ থেকে ২০১৪ সালের টেটে অনুত্তীর্ণ প্রার্থীদের চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে নামের তালিকা ও মাথাপিছু চার থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা নিয়েছিলেন শান্তনু। প্রায় ১৯ জনের নামের তালিকা ও টাকা দিয়েছিলেন বলে জবানবন্দিতে দাবি করেছেন ওই সাক্ষী। কিন্তু টাকা নেওয়ার পরও চাকরির কোনও ব্যবস্থা শান্তনু করেননি বলে অভিযোগ তাঁর।
জবানবন্দিতে আর এক সাক্ষী দাবি করেছেন, কুন্তল ও শান্তনুর কাছে একাধিক বার টাকা ফেরত চাওয়া হয়েছিল। তাঁরা শুধু জানিয়ে ছিলেন, ধৈর্য ধরতে হবে। সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রের কাছে সমস্ত টাকা জমা দেওয়া হয়েছে ও প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের অপসারিত সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের সঙ্গে রফা করে ওই চাকরির ব্যবস্থা করছেন সুজয়।
সিবিআইয়ের জমা দেওয়া নথি অনুযায়ী, কুন্তলের অফিসের কর্মচারী জানান, তাপস মণ্ডল প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতির অন্যতম ‘মিডলম্যান’। এক দিন ফোন করে কুন্তলকে তাপস জানান, কলকাতার বেলেঘাটা এলাকায় কয়েক কোটি টাকার নগদ নিয়ে তিনি এসেছেন। এর পরই কুন্তলের নির্দেশে তিনি ও আর এক জন বেলেঘাটায় গিয়ে তাপসের গাড়ি থেকে কয়েকটি ট্রলি ব্যাগে নগদ টাকা নেন ও আর একটি গাড়িতে নিউ টাউনের ফ্ল্যাটে নিয়ে আসেন। মেশিন দিয়ে কয়েক কোটি টাকা গোনা হয়। অযোগ্য প্রার্থীদের নামের তালিকা-সহ আলাদা আলাদা করে খবরের কাগজে মুড়ে টাকা সুজয়ের বেহালার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়।
এই সাক্ষীরা তাঁদের বয়ানে জানান, টাকা দেওয়ার পর চাকরি না পাওয়ায় অযোগ্য প্রার্থীরা বারবার চাপ দিচ্ছিলেন। এরপর তাঁদের ও কুন্তলের অফিসের কর্মচারীদের নিয়ে শান্তনু ও কুন্তল সুজয়কৃষ্ণের বাড়িতে বৈঠক করেন। বৈঠকে উপস্থিত কুন্তলের অফিসের এক কর্মচারী পুরো বৈঠকের কথোপকথন তাঁর মোবাইল ফোনে ‘ভয়েস রেকর্ডিং’ করেন। পরে মোবাইল ফোনটি ক্রমশ ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যাওয়ায় একটি পেনড্রাইভের মাধ্যমে ওই ‘ভয়েস রেকর্ডিং’ নিজের ল্যাপটপে রেখে দেন। পরে যা তিনি সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিয়েছেন। চার্জশিটে সেই রেকর্ডিংয়ের উল্লেখ করেই সিবিআই জানিয়েছিল, ওই বৈঠকে ‘কাকু’ জনৈক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম করে বেশ কিছু কথা বলেন। তবে লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের প্রাক্তন ডিরেক্টর তথা ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আইনজীবী সঞ্জয় বসু একটি লিখিত বিবৃতিতে জানিয়ে দেন, সিবিআই কোনও অভিযোগের সত্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে না পেরে তাঁর মক্কেলের নাম কালিমালিপ্ত করছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)