প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জায়গায়। অর্থাৎ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। কিন্তু সরকার চালানোর ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা হবে রাজ্যের সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘোষিত এই নীতির কথা বঙ্গ সফরে এসে মনে করিয়ে দিলেন এবং বুঝিয়েও দিলেন তাঁর সরকারের জাহাজ ও ভূতল পরিবহণ মন্ত্রী নিতিন গডকড়ী।
বুধবার হলদিয়া বন্দরের কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে জাহাজমন্ত্রী বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের জন্য আরও ২৫-৩০ হাজার কোটি টাকা আলাদা করে রেখেছি। মমতাজি (মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) প্রস্তাব দিলেই তা পাঠানো হবে।’’
কী ধরনের প্রস্তাব?
‘‘এ রাজ্যে ২০০০ কিলোমিটার জাতীয় সড়ক রয়েছে। বাংলায় আরও ২০০০ কিলোমিটার জাতীয় সড়ক নির্মাণ করতে চায় কেন্দ্র। সেই খাতেই ৩০ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হবে,’’ সাংবাদিক বৈঠকে বললেন গডকড়ী। এই বিষয়ে এ দিন সকালে ফোনে মমতার সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে বলেও জানান মন্ত্রী। সবিস্তার আলোচনার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মমতা ব্যস্ত থাকায় তাঁদের দেখা হয়নি। ‘‘নতুন জাতীয় সড়ক নির্মাণের জন্য রাজ্য সবিস্তার প্রকল্প রিপোর্ট (ডিপিআর) পাঠালে কেন্দ্র তা দ্রুত মঞ্জুর করবে,’’ আশ্বাস দিয়েছেন জাহাজমন্ত্রী।
রাজনীতি আর কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক, দু’টো বিষয়কে তাঁরা যে পৃথক করে দেখছেন, আগেও রাজ্যে এসে তার প্রমাণ দিয়েছিলেন গডকড়ী। সে-বার তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপির মিছিলে যোগ দেওয়ার পরেই সেখান থেকে সোজা নবান্নে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন তিনি। তাঁদের মধ্যে জাতীয় সড়ক ও বন্দরের সমস্যা নিয়ে কথা হয়েছিল। গডকড়ী সেই বৈঠকেও কেন্দ্রের তরফে সব রকম সহযোগিতার বার্তা দেন মুখ্যমন্ত্রীকে। তার পুনরাবৃত্তি হল এ দিন। তবে গডকড়ীর এ বারের সহযোগিতার বার্তার মধ্যে বাড়তি তাৎপর্য দেখছেন অনেকে। কারণ, এখন বিজেপি এবং তৃণমূলের নৈকট্য নিয়ে জোরদার জল্পনা চলছে।
কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গে জাতীয় সড়কের দৈর্ঘ্য বাড়াতে চাইছে কেন?
‘‘ভারত এখন নেপাল, বাংলাদেশ, ভুটান ও মায়ানমারের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ গড়তে চায়। সেই কারণেই পশ্চিমবঙ্গে জাতীয় সড়কের আরও উন্নয়ন প্রয়োজন,’’ ব্যাখ্যা দিলেন গডকড়ী। শুধু জাতীয় সড়ক নয়। সাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর ও গঙ্গায় পণ্য চলাচলের ব্যবস্থা করতে হলদিয়ায় মাল্টি মোডাল হাব নির্মাণ- সহ একাধিক প্রকল্পে কেন্দ্র যে কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে, সেটাও মনে করিয়ে দেন জাহাজমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘কলকাতাকে কেন্দ্র করে এ রাজ্য বিকশিত না-হলে পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারত এগোবে না। তাই উন্নয়নের প্রশ্নে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করবে কেন্দ্রীয় সরকার।’’
এই মনোভাব থেকেই কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি কিছু দিন আগে জানিয়েছেন, চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ মেনে এ বার আগের চেয়ে বেশি টাকা পাবে রাজ্য। চলতি অর্থবর্ষে ১০০ দিনের কাজে রাজ্য রেকর্ড পরিমাণ ৬০০০ কোটি টাকা পাবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক। সহযোগিতার সঙ্গে সৌজন্যের বার্তা দিয়ে সম্প্রতি নিউ ইয়র্কে বসে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গ লগ্নি টানার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কাজ করছে।
মোদী সরকারের তরফ থেকে বারবার এমন সহযোগিতার বার্তা দেওয়া হলেও মমতার সরকার কিন্তু দিল্লির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নরম-গরম মনোভাব বজায় রেখে চলেছে। নবান্নের কর্তাদের একাংশের মতে, কয়েক দিন আগেই কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগ তুলে বিধানসভায় প্রস্তাব গ্রহণ করেছে শাসক দল। আবার এরাই ললিত মোদী-বিতর্কে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর স্বচ্ছ ভারত অভিযানে সামিল না-হলেও যোগ দিবসের অনুষ্ঠান পালন করেছে সরকার। কিন্তু মমতার সরকারের কোনও মন্ত্রী বা আমলা যোগ দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ নেননি। একই ভাবে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় আসানসোলে ইএসআই হাসপাতালের আধুনিকীকরণের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর সহযোগিতা চাইলে তাতে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন মমতা। ঝালমুড়ি পর্বের রেশ মেলাতে না-মেলাতেই বেঙ্গল ক্যাডারের আইএএস অফিসার অভিনব চন্দকে বাবুলের সচিব হওয়ার জন্য দিল্লি যেতে অনুমতিও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু বিভিন্ন জেলায় শাসক দলের হাতে বিজেপি-কর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বেড়েই চলেছে বলে অভিযোগ উঠছে প্রায় প্রতিদিন।
তাল কেটেছে এ দিনও। তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বলে স্থানীয় তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী হলদিয়ার অনুষ্ঠানে যাননি। তিনি বলেন, ‘‘বন্দর তো প্রথা মেনে আমাকে আমন্ত্রণই জানায়নি। অফিসে একটি কার্ড ফেলে দিয়ে গিয়েছে। ঠিক করেছি, লোকসভার স্পিকারের কাছে বন্দরকর্তাদের নামে অভিযোগ করব।’’ কলকাতা বন্দরের চেয়ারম্যান রাজপাল সিংহ কাহালোঁ অবশ্য বলেন, ‘‘সাংসদকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল, ফোনও করা হয়েছিল। তাঁর দফতর জানায়, তিনি হলদিয়ায় নেই, তাই থাকতে পারবেন না।’’
সব শুনে জাহাজমন্ত্রী প্রকাশ্যেই দুঃখ প্রকাশ করেন। তাঁর কথায়, ‘‘এমন অনুষ্ঠানে স্থানীয় সাংসদকে সব সময়েই আমন্ত্রণ জানানো হয়। এ বারেও হয়েছে। তার পরেও কোনও রকম ভুল বোঝাবুঝি হয়ে থাকলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। উন্নয়নের প্রশ্নে সদ্ভাবটাই বড় কথা।’’
কিন্তু হলদিয়ায় শেষ পর্যন্ত সেই সদ্ভাব বজায় থাকল কি?
কোথায় সদ্ভাব, প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় বিজেপি নেতা সুকুমার দাস। তাঁর অভিযোগ, মমতার পুলিশ বিজেপির জেলা নেতাদের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ধারেকাছেই ঘেঁষতে দেয়নি। হলদিয়া পুরসভার চেয়ারম্যান দেবপ্রসাদ মণ্ডল মন্ত্রীকে ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগত জানালেও জেলা বিজেপি নেতাদের হেলিপ্যাড থেকে কার্যত ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দিয়েছে স্থানীয় পুলিশ। সে-কথা জানতে
পেরে পরে গডকড়ী অবশ্য তাঁদের সঙ্গে অন্য একটি অনুষ্ঠানে দেখা করেন। কথাও বলেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy