সালটা ছিল ১৮৯৯। তারিখ, ৫ মার্চ। কলকাতার তাপমাত্রা সে দিন নেমে গিয়েছিল ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে! ভরা বসন্তে হিমেল হাওয়ায় ঠকঠকিয়ে কাঁপতে হয়েছিল মহানগরকে।
আলিপুর আবহাওয়া দফতরের নথি অনুযায়ী ১১৬ বছর আগের সেই মার্চ মাসই এ যাবৎ শীতলতম। ২০১৫-র মার্চ সে রেকর্ড ভাঙতে পারেনি ঠিকই। পাশাপাশি এটাও ঠিক যে, গত দশ বছরে এমন ঠান্ডা মার্চ আর আসেনি। ঋতুচক্রের স্বাভাবিক নিয়ম বলে, ফেব্রুয়ারি ইস্তক ঠান্ডার আমেজ পোহানোর পরে মার্চে এসে থার্মোমিটারের পারদ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী হবে। এপ্রিল যত এগিয়ে আসবে, দিনের তাপমাত্রা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে। আলিপুরের নথি মোতাবেক, গত দশ বছরে মার্চ মাসে কলকাতার তাপমাত্রা আকছার ৩৭-৩৮ ডিগ্রি ছুঁয়েছে। পাঁচ বছর আগের ২২ মার্চে তো প্রায় ৪০ ডিগ্রিতে পৌঁছে গিয়েছিল! মহানগর পড়ে গিয়েছিল তাপপ্রবাহের কবলে!
ঘটনাচক্রে রবিবারও ছিল ২২ মার্চ। অথচ তাপপ্রবাহ দূর অস্ত্, এ দিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কোনও মতে স্বাভাবিকের গণ্ডি পেরিয়ে ৩৫.৮ ডিগ্রিতে দাঁড়িয়েছে। ভোরের দিকে এখনও পাখা বন্ধ করে চাদর মুড়ি দিলে আরাম মিলছে। এবং পরিবর্তনের এই রহস্যের উৎস খুঁজতে গিয়ে আবহবিদদের নজর চলে যাচ্ছে সুদূর কাশ্মীরে। বিস্তৃত ভাবে ধরলে, ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায়। কী রকম?
ওরা জানাচ্ছেন, পূর্ব ভারতে শীত বিদায় নিলেও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে পর পর ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা (পশ্চিমী ঝঞ্ঝা) আছড়ে পড়ছে কাশ্মীরে। তার জেরে সেখানে বৃষ্টি-তুষারপাতের বিরাম নেই। ফলে উত্তর-পশ্চিম ভারত জুড়েও তাপমাত্রা সে ভাবে বাড়তে পারছে না। উল্টে উত্তর ভারত থেকে শিরশিরে হিমেল বাতাস ধেয়ে এসে পূর্ব ভারতে তাপমাত্রাকে দাবিয়ে রাখছে।
বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আলিপুর হাওয়া অফিসের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ এ দিন বলেন, পশ্চিমী ঝঞ্ঝার প্রভাবে উত্তর-পশ্চিম ভারতে স্থানীয় ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হচ্ছে, যার রেশ ছড়িয়ে যাচ্ছে উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে মধ্য ভারত পর্যন্ত। সেখানে বৃষ্টি হচ্ছে, তাপমাত্রা স্বাভাবিক ভাবে বাড়তে পারছে না। আর ওই তল্লাটের হাওয়া তপ্ত না-হলে পশ্চিমবঙ্গেও গরম পড়বে না। “গত বছর এমনই হয়েছিল।” বলছেন গোকুলবাবুর।
গত বছর মার্চের শেষাশেষি গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে পারদ চড়তে শুরু করেছিল। ৩০ মার্চ কলকাতার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছুঁয়ে তাপপ্রবাহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। কিন্তু এ বছর তেমনটি হবে কি না, সে নিশ্চয়তা নেই। গরম সে ভাবে না-পড়লে জীবাণুঘটিত বিভিন্ন রোগের দাপটও কমবে না বলে চিকিৎসকেরা ইতিমধ্যে হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন।
শুধু গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ নয়। চরম আবহাওয়ার জন্য খ্যাত দক্ষিণবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চল কিংবা বিহার-ঝাড়খণ্ডের ছোটনাগপুর মালভূমিতেও গরমের দেখা নেই! বিহার-ঝাড়খণ্ডের কোথাও কোথাও তো মাঝে-মধ্যে বৃষ্টিও হচ্ছে! আলিপুর হাওয়া অফিসের এক কর্তার কথায়, “বাঁকুড়া-শ্রীনিকেতনে যেখানে মার্চে তাপমাত্রা হামেশা ৩৯-৪০ ডিগ্রিতে উঠে যায়, এ বার সেখানে দিনের তাপমাত্রা ৩৫-৩৬ ডিগ্রির চৌহদ্দি-ই ছাড়াচ্ছে না!” আবহবিদদের অনেকে বলছেন, ক’বছর ধরে শীতের বিদায় কিছুটা পিছিয়ে যাচ্ছে। শীত-শীত ভাব থাকাকালীনই আচমকা এসে হাজির হচ্ছে গ্রীষ্ম।
আর এ ভাবেই ঋতুচক্র থেকে বসন্ত ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। বস্তুত ‘বসন্ত বিলোপের’ ছবিটা এ বার যেন বড্ড বেশি প্রকট। যার প্রেক্ষাপটে নতুন করে উঠে আসছে পশ্চিমী ঝঞ্ঝার বাড়বাড়ন্তের প্রসঙ্গ। প্রশ্ন উঠছে, এ কি বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনেরই পরিণতি?
আবহবিদদের কারও কারও মতে, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের জলবায়ুতে লক্ষণীয় যে পরিবর্তন, ভারতের আবহাওয়ায় তারই প্রভাব পড়েছে। যে তত্ত্ব মানতে নারাজ মৌসম ভবনের বিজ্ঞানীরা। ওঁদের বড় অংশের বক্তব্য: পর পর দু’বছর পশ্চিমী ঝঞ্ঝার দাপটে বসন্ত উধাও হয়েছে ঠিকই, তবে এই পরিবর্তনকে এখনই জলবায়ুর ‘স্থায়ী বদল’ হিসেবে চিহ্নিত করাটা যুক্তিযুক্ত নয়। “ঝঞ্ঝার পরাক্রম যদি এর পরেও চলতে থাকে, তখন বলা যেতে পারে যে, জলবায়ুতে সত্যিই পরিবর্তন এসেছে।” মন্তব্য করেছেন কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের এক শীর্ষ কর্তা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy