Advertisement
E-Paper

ছাত্র দমনে পাঠানো হয়েছিল কম্যান্ডো

জঙ্গি দমনে যারা যায়, তাদেরই পাঠানো হল পড়ুয়া-দমনে! যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ঘেরাও আন্দোলন দমন করতে মঙ্গলবার রাতে যাদের পাঠানো হয়েছিল, তাদের মধ্যে অন্তত ১০ জন ছিলেন কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ফোর্সের কম্যান্ডো বাহিনীর সদস্য। এমন তথ্য মিলছে খোদ কলকাতা পুলিশের অন্দরেই।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:৫২

জঙ্গি দমনে যারা যায়, তাদেরই পাঠানো হল পড়ুয়া-দমনে!

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ঘেরাও আন্দোলন দমন করতে মঙ্গলবার রাতে যাদের পাঠানো হয়েছিল, তাদের মধ্যে অন্তত ১০ জন ছিলেন কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ফোর্সের কম্যান্ডো বাহিনীর সদস্য। এমন তথ্য মিলছে খোদ কলকাতা পুলিশের অন্দরেই।

এই কম্যান্ডো বাহিনীর সদস্যদের সাধারণত ডাক পড়ে জঙ্গি-দমনে। চূড়ান্ত শারীরিক শক্তির প্রয়োজন হয় যেখানে, সেখানে ডাকা হয় এঁদের। ‘সংবেদনশীলতা’ শব্দটিই নেই তাঁদের প্রশিক্ষণে। যদিও ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা পরে লালবাজারের সাংবাদিক বৈঠক ডেকে কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ দাবি করেছিলেন, “ফোর্স যথেষ্ট সংবেদনশীল ও ধৈর্য্য সহকারে বিষয়টি সামলেছে।”

সিপি-র ওই দাবি সে দিনই এক রকম খারিজ করে দেন লালবাজারের একটা বড় অংশ। তাঁরা বরং জানাচ্ছেন, পেশাগত কারণেই কম্যান্ডোদের ‘সংবেদনশীলতা’ থেকে দূরে থাকতে বলা হয়। মঙ্গলবার রাতে লালবাজারের শীর্ষ কর্তারা এই বাহিনীরই বাছাই করা দশ জনকে পাঠিয়েছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। যাদের নেতৃত্বে ছিলেন রাজকুমার সিংহ। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে রাজকুমারদের উগ্র আচরণ নিয়ে সে দিনই প্রশ্ন উঠেছিল।

কোথায় প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন রাজকুমার? পুলিশ সূত্রের খবর, জঙ্গি দমনে দেশের অন্যতম ভরসা ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড (এনএসজি) থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন রাজকুমার। চলতি কথায় এঁদের বলা হয়, ব্ল্যাক ক্যাট কম্যান্ডো। ২৬/১১-র সময় মুম্বইয়ের তাজ, ট্রাইডেন্ট হোটেলের ভিতরে ঢুকে জঙ্গিদের নিকেশ করে পণবন্দিদের উদ্ধার করেছিলেন এই এনএসজি জওয়ানরাই।

তা হলে কি লালবাজারের শীর্ষকর্তারা মনে করেছিলেন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীকে মুক্ত করতে প্রয়োজন ছিল এমনই বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনীর?

লালবাজারের একটি সূত্র বলছে, ওই রাতে রাজ্যের এক প্রভাবশালী ছাত্রনেতা কলকাতা পুলিশের এক কর্তাকে বারবার ফোন করে এমনই কড়া বাহিনীকে পাঠাতে বলেছিলেন। ওই পুলিশকর্তা তাঁকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, ছাত্র আন্দোলন ঠেকাতে এই বাহিনী ব্যবহারের নজির অতীতে নেই। বরং, এমন বাহিনী পাঠালে হিতে বিপরীত হতে পারে বলেও সতর্ক করেছিলেন ওই পুলিশকর্তা। কিন্তু শাসক দলের ছাত্রনেতা তাতে কান দেননি। শেষে প্রশাসনের শীর্ষস্তরের হস্তক্ষেপে কম্যান্ডো বাহিনীকেই পাঠানো হয় বলে লালবাজারের ওই সূত্রের দাবি।

এ প্রসঙ্গে কলকাতা পুলিশের এক পদস্থ কর্তার দাবি, “ছাত্র আন্দোলন ঠেকাতে চিনের তিয়েন আন মেন স্কোয়ারে সেনা ব্যবহার করা হয়েছিল। ছাত্র আন্দোলনে বিশেষ বাহিনীকে ব্যবহার করার নজির সারা বিশ্বেই প্রায় নেই।” আবার ছাত্র আন্দোলন-ঘেরাওয়ের নজিরও শহরে কম নেই। আন্দোলন থামাতে কখনও-সখনও পুলিশ লাঠিপেটা করলেও কোথাও কম্যান্ডো নামানো হয়নি। বরং অনেক সময় কৌশলে আন্দোলনকারীদের মাঝখান থেকে কলেজের অধ্যক্ষকে বের করে এনেছেন ঠান্ডা মাথার অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসারেরা।

পুলিশই বলছে, ২০০৯ সালে খাস মহাকরণে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ঘর ঘেরাও করেছিলেন বিরোধী দলনেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায়-সহ কয়েক জন তৃণমূল নেতা। তখনও মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্ধার করতে কম্যান্ডো ডাকা হয়নি। বরং কলকাতা পুলিশের তৎকালীন যুগ্ম কমিশনার (এসটিএফ) রাজীব কুমারের কৌশলে কার্যত ধাক্কাধাক্কি এড়িয়েই বিক্ষোভ সরানো গিয়েছিল। লালবাজারের একাংশ বলছেন, সাম্প্রতিক কালে স্টিফেন কোর্টের আগুনে কম্যান্ডো ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ, দড়ি বেয়ে বহুতল থেকে লোকজনকে নামিয়ে আনা সাধারণ পুলিশকর্মীদের সাধ্যে কুলোত না।

পুলিশের একাংশ বলছেন, কম্যান্ডো মানেই মারকুটে, কড়া চেহারার পুলিশ। সে ভাবেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাঁদের। খালি হাতে লড়াই করতে ক্যারাটে-কিক বক্সিংয়ের মতো মার্শাল আর্টও শেখানো হয়। সাধারণত দু’জন করে কম্যান্ডোদের একটি দল তৈরি করা হয়। অপারেশন শুরু হলে কার্যত যন্ত্রের মতো কাজ করেন কম্যান্ডোরা। রাজকুমার সিংহ কলকাতা পুলিশের বক্সিং ও কিক বক্সিং দলের অন্যতম প্রশিক্ষক। অভিযোগ, মঙ্গলবার রাতের অপারেশনের দলটি তিনিই গড়েছিলেন। তিনি-ই সদস্যদের বাছাই করেছিলেন।

কলকাতা পুলিশের এক আইপিএস কর্তার বক্তব্য, “মারধর করা নিয়ে কম্যান্ডোদের সমালোচনা করে লাভ নেই। কারণ ওদের কাজের ধরনটাই ওই রকম।” তাঁর মতে, কম্যান্ডো নামানোর সিদ্ধান্তটাই ভুল ছিল। সেই ভুল লালবাজারের শীর্ষ কর্তারা কেন করলেন, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন ওই কর্তা। লালবাজারের শীর্ষ কর্তারা অবশ্য তাঁদের তরফে কোনও ত্রুটির কথা মানতে নারাজ।

কী ঘটেছিল মঙ্গলবার রাতে?

পুলিশ সূত্রের খবর, যাদবপুরে উপাচার্যকে রাত পর্যন্ত ঘেরাও করে রাখা হয়েছে শুনেই যাদবপুর থানা থেকে বাহিনী পাঠানো হয়। সঙ্গে লালবাজারের সদর দফতর থেকে আরও পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। অতিরিক্ত কমিশনার (৩) দেবাশিস রায় ও যুগ্ম কমিশনার (প্রশাসন) মেহবুুব রহমানও সেখানে যান। আশপাশের থানা থেকে বাছাই করা কিছু পুলিশকর্মীকেও সেখানে পাঠানো হয়। প্রথমে পুলিশকর্তারা ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে আপসে বিষয়টি মেটনোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পড়ুয়ারা তাতে সায় দেননি। ইতিমধ্যে উপাচার্য বারবার ফোন করে পুলিশকে উদ্ধার করার জন্য চাপ দিতে থাকেন। অভিযোগ, লালবাজারের উচ্চকর্তা এবং রাজনৈতিক নেতাদেরও ফোন করেন উপাচার্য।

পুলিশকর্তাদের একাংশ বলছেন, সিপি এবং হাতেগোনা কয়েক জন শীর্ষকর্তার নির্দেশ ছাড়া কম্যান্ডোর মতো বিশেষ বাহিনীকে নিয়োগ করা যায় না। বারবার ফোন পাওয়ার পরে এক সময় যাদবপুরে থাকা পুলিশকর্তারা কন্ট্রোল রুম মারফত জানতে পারেন, পুলিশ ট্রেনিং স্কুল থেকে দশ জন কম্যান্ডো আসছেন। রাত একটার পরে কম্যান্ডোরা এসে পৌঁছন যাদবপুরে। রাত আড়াইটে নাগাদ হঠাৎই অরবিন্দ ভবনের সামনে আলো নিভে যায়। তার পরেই শুরু হয় ‘অপারেশন’।

কে নেভাল ওই আলো?

পুলিশ কমিশনার বৃহস্পতিবার জানিয়েছিলেন, পুলিশ আলো নেভায়নি। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, অরবিন্দ ভবনে থাকা শাসক দল ঘনিষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কর্মচারী ওই আলো নেভানোর সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন। তবে পুলিশের অন্য একটি অংশ বলছেন, আলো নেভানো পরিকল্পিত ভাবেই করা হয়েছে। কারণ, কম্যান্ডোরা রাতের অন্ধকারে অপারেশনের জন্য বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষিত।

পুলিশ সূত্রের খবর, প্রশাসনের কোনও শীর্ষ স্তর থেকে চাপ আসায় কোনও রকম পরিকল্পনা ছাড়াই কম্যান্ডো পাঠাতে হয়েছিল লালবাজারের শীর্ষকর্তাদের। মঙ্গলবার মাঝরাতে কম্যান্ডোদের যখন ঘটনাস্থলে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়, তখন তাঁদের অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তার মধ্যে থেকেই দশ জনকে তুলে নিয়ে পাঠানো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে।

commando jadavpur university student suppression latest news online news latest news online
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy