Advertisement
E-Paper

খাব না ও খাবুনি-র দ্বন্দ্বে বাড়ে অস্বস্তি

সুইসাইড নোট থেকে অনুমান, কলেজের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না তিনি। সহপাঠীরা ইংরেজি আর হিন্দিতে কথা বলেন। শিক্ষক ক্লাসে ইংরেজিতে পড়ান। তাঁর বুঝতে অসুবিধা হয়। গ্রাম থেকে মহানগরের আসা ছাত্রটি অস্বস্তিতে পড়তেন। 

দীপক দাস

শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৯ ০২:৫৩
Share
Save

বাস থেকে নেমে হাসির হুল্লোড় তুলেছিল বন্ধুরা। এক বন্ধু আর এক বন্ধুর নাম করে বলেছিল, ‘‘ও সারা রাস্তায় কী বলতে বলতে এসেছে, আমরা পৌঁছনোর পরেই গড়িয়ে পড়ে যাব।’’ গড়িয়ে পড়ব কেন? বন্ধুটির ব্যাখ্যা, ‘‘ওর বাড়ি তো পৃথিবীর শেষ প্রান্তে। স্যাট করে পৃথিবীর গা দিয়ে গড়িয়ে পড়ব।’’ শহরের বন্ধুরা দল বেঁধে এসেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধুর গ্রামে ঘুরতে। দূরত্ব ঘণ্টা আড়াইয়ের। গ্রামের বন্ধুটি কিন্তু প্রতিদিন এই দূরত্ব উজিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেত। আবার ভাটার টানে ঘরে ফিরত।

গড়িয়ে পড়া বন্ধুদের নেহাতই রসিকতা। অবমাননাকর নয়। কিন্তু প্রায় ১৮ বছর পরে মনে পড়ে গেল ঘটনাটি। হুগলির সিঙ্গুরের ছেলে হৃষীক কোলের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায়। হৃষীক মেধাবী ছাত্র। পড়তেন কলকাতার একটি নামী কলেজে। তাঁর সুইসাইড নোট থেকে অনুমান, কলেজের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না তিনি। সহপাঠীরা ইংরেজি আর হিন্দিতে কথা বলেন। শিক্ষক ক্লাসে ইংরেজিতে পড়ান। তাঁর বুঝতে অসুবিধা হয়। গ্রাম থেকে মহানগরের আসা ছাত্রটি অস্বস্তিতে পড়তেন।

জেলা থেকে বড় শহরে আসা ছেলে মেয়েদের কাছে ভাষা সত্যিই একটা সমস্যা। সে ভাষা ইংরেজি হতে পারে, হিন্দি হতে পারে। আবার আঞ্চলিক ভাষার টানে বলা মাতৃভাষাও হতে পারে। অফিসে, কলেজে গ্রামের ছেলেমেয়েরা প্রথমে তার মুখের বুলির জন্যই ‘বলি’ হয়। ‘খাব না, যাব না’র সঙ্গে ‘খাবুনি, যাবুনি’র দ্বন্দ্ব। উচ্চারণে ‘শ’এর দোষ। তা নিয়ে হাসাহাসি। হাসতে হাসতেই উচ্চারণ ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা। যাকে নিয়ে চেষ্টা, সে ভিতর থেকে কুঁকড়ে যেতেই পারে। বাংলা নিয়ে পড়া সেই ছেলেটির বলতে ইচ্ছে করে, যাকে তোমরা মান্য বাংলা বলছো তা ঘটনাচক্রের দান। ইংরেজরা কলকাতায় রাজধানী না গড়লে ‘খাব না, যাব না’ হত আঞ্চলিক। এর পর হিন্দি। আম বাঙালির হিন্দি উচ্চারণ বলিউডের সিনেমায় দেখানো বাঙালি চরিত্রটির মতো। সিনেমা দেখে হিন্দি শেখা আমার মতো জেলার ছেলেরা হাসাহাসির ভয়েই হিন্দি বলে না।

আর ইংরেজি? বুঝতে পারলেও বলতে পারে না। অল্প বলতে পারলেও লিখতে পারে না। ফলে চাকরি ছাড়তে চাইলে

ইস্তফাপত্র টাইপ করে দেন সহকর্মী। দেখে অন্য সহকর্মীর টিপ্পনি, ‘‘নিজের ইচ্ছেয় চাকরিও তো ছাড়তে পারবি না রে।’’ অন্য অফিসে এসে আরও বিপাকে সে। বছরের শেষে একটা ফর্ম আসে। তাতে নিজের কাজের বিচার করে, নিজের খামতি-গুণ নিয়ে দু’চার কথা লিখতে হয়। সহকর্মীরা প্রায় সকলেই ইংরেজিতে লিখলেও ছেলেটি লেখে বাংলায়। তার পর শুনতে পায়, তার বাংলা লেখাটা খবর হয়ে দাঁড়িয়েছে অফিসে। কী করবে ছেলেটি? সে-ই যে বাড়ির প্রথম উচ্চ মাধ্যমিক পাশ!

শুধু ভাষা নয়। পোশাক, খাদ্যাভ্যাস সবেতেই অস্বস্তিতে পড়তে হয় জেলার ছেলেদের। রাজধানীর শপিং মলে যে পোশাক মেলে, তা শশধর বস্ত্রালয়ে মেলা সম্ভব নয়। গ্রামের বাড়ির কাছে বড় জোর ফুচকাওয়ালাকে দেখা যায়। ঠেলায় ইডলি-ধোসা বা পাড়ায় ফাস্ট ফুডের স্টল ভিন্‌ গ্রহের ব্যাপার। ফলে মুড়িতেই অভ্যস্ত সে। তাই শহুরে বন্ধুর মা যখন জিজ্ঞাসা করেন, ‘টিফিনে কী খাবি?’ ছেলেটি স্বভাবতই উত্তর দেয়, মুড়ি। শুনে বন্ধুর মায়ের মুখে স্নেহশীল হাসি। ছেলেটির মনে হয়, কাকিমার মুখে শুধু স্নেহ থাকলেই ভাল হত।

এত কিছুর মধ্যেই গ্রাম-শহরের দূরত্বটা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। দূর মানেই সেই পৃথিবীর গা দিয়ে গড়িয়ে পড়ার তত্ত্ব। রাতে অফিস থেকে ফেরার সময়ে এক দিন বড় গাড়ি দিয়েছিল। তা দেখে এক সহকর্মীর মন্তব্য, ‘আজ পাড়ার লোক চমকে উঠবে। কাল তোর বাড়িতে মাংস ভাত।’ ছেলেটা কী করে বোঝায়, সে যখন বাড়ি ফেরে তখন রাস্তায় থাকে কয়েকটা শিয়াল, রগচটা, সন্দেহবাতিক দু’টো কুকুর। আর বিদ্যুতের তারে একটা পেঁচা। পুরো গ্রাম তার ঘণ্টা দু’য়েক আগে ঘুমিয়ে পড়েছে। একটা সময়ে ছেলেটিকে পৌঁছে দিতে সহজে রাজি হতেন না অফিসের গাড়ির চালকদের কেউ কেউ। গ্রামের রাস্তায় যে আলো নেই! ‘ডর’ লাগত তাঁদের। ছেলেটির অস্বস্তি হত, গ্রামের অন্ধকারের জন্য সে-ই কি দায়ী?

শহর থেকে দূর মানেই প্রান্ত? সেখানকার লোকজন প্রান্তবাসী? এরকম ধারণা করেন শহরবাসীরা? সকলেই হয়তো নন। তবুও প্রতিদিন টুকরো টুকরো হাসি মজার নানা তুচ্ছ ঘটনায় কেউ কেউ মনে মনে দমে যেতে পারেন। না, হৃষীক কিন্তু কারও প্রতি দোষারোপের আঙুল তোলেননি। আঙুল নিজের দিকেই, মানিয়ে নিতে না পারা। কিন্তু তার জন্য তো হারিয়ে যাওয়ার কোনও অর্থ হয় না। মেধাবী ছাত্রটি ভাষার অস্বস্তি কাটিয়ে উঠেও নিজেকে প্রমাণ করতে পারতেন।

হারিয়ে যাওয়ার আগে একবার দাঁড়িয়ে যাওয়া ভাল। নতুন করে ভেবে দেখার জন্য।

Language Student Death Suicide

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy