কার ভাণ্ডারে থাকবে ‘অমূল্যরতন’, তা নিয়ে জোর লড়াই বেধেছে স্বাস্থ্য দফতরের দুই বিভাগে!
এই দুই বিভাগের মাথায় রয়েছেন স্বাস্থ্য দফতরের দুই শীর্ষকর্তা। হেলথ সার্ভিস বিভাগের শীর্ষে রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী আর স্বাস্থ্যশিক্ষা বা মেডিক্যাল এডুকেশন বিভাগের (এমইএস) শীর্ষে স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। যে মূল্যবান রত্ন নিয়ে তাঁদের টানাপড়েন, সেটি হচ্ছে-‘স্পেশ্যালিস্ট’(বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক)।
তা এতটাই চরমে উঠেছে যে, একেবারে নোটিস জারি করে হেলথ সার্ভিস থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের এমইএস বা স্বাস্থ্যশিক্ষা বিভাগে যোগ দেওয়ার দীর্ঘ দিনের নিয়মে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, হেলথ সার্ভিস থেকে মেডিক্যাল সার্ভিসে যেতে হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে তবে যোগ দিতে হবে।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, এতে ব্যাপক খেপে গিয়েছেন হেলথ সার্ভিসের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ। এই লড়াইয়ে তাঁদের ‘বলির পাঁঠা’ হতে হচ্ছে বলে শীর্ষ পদে থাকা একাধিক কর্তার কাছে ক্ষোভ জানিয়েছেন তাঁরা। প্রায় প্রতি দিনই হেলথ সার্ভিসে দুই থেকে তিন জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ইস্তফাপত্র জমা দিচ্ছেন। যাঁরা সেটা করছেন না, তাঁদের মধ্যেও অনেকে হতাশ বলছেন, ‘‘এক দফতরে একই সচিবের আওতায় থাকা সত্ত্বেও আমাদের এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। দায়দায়িত্ব আছে বলে হয়তো চাকরি ছাড়তে পারব না। কিন্তু বিশেষজ্ঞ হয়েও হেলথ সার্ভিসে পড়ে থেকে জেলার হাসপাতালে জেনারেল ডিউটি করে যেতে হবে, এটাও সহ্য করতে পারছি না। এ বার থেকে আমরাও দায়সারা কাজ করব।’’
সরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের আকাল বেশ কিছু দিন ধরেই চলছিল। তা মারাত্মক আকার নিয়েছে গত এক-দেড় বছরে। কারণ, রাজ্যজুড়ে সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল তৈরির পাশাপাশি পুরনো মেডিক্যাল কলেজগুলিতে আসনবৃদ্ধি ও একাধিক নতুন মেডিক্যাল কলেজ খোলার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালগুলি হেলথ সার্ভিস বিভাগ অর্থাৎ স্বাস্থ্য অধিকর্তার অধীনস্থ। ফলে সেগুলি চালাতে প্রচুর বিশেষজ্ঞ দরকার। গত কয়েক দফায় বিশেষজ্ঞ নেওয়ার বিজ্ঞাপন দিয়েও হেলথ সার্ভিস লোক পায়নি।
আবার মেডিক্যাল কলেজগুলি মেডিক্যাল এডুকেশন বিভাগ অর্থাৎ ডিএমই-র অধীনস্থ। সেখানেও স্পেশ্যালিস্টের অভাবে ‘মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’ অনেক মেডিক্যাল কলেজে নতুন বিভাগ খোলার অনুমতি দিচ্ছে না, ছাত্রসংখ্যা বাড়াতে দিচ্ছে না। নতুন মেডিক্যাল কলেজ চালু হলে তার জন্য বিশেষজ্ঞ কী ভাবে জোগাড় হবে, সেই প্রশ্নও রয়েছে। অভাব মেটাতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অবসরের বয়স আরও বাড়িয়ে ৬৮ করার ফাইল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে জমা পড়েছিল। কিন্তু অনুমোদিত হয়নি। অর্থাৎ, স্পেশ্যালিস্টের বিপুল অভাব স্বাস্থ্য দফতরের দুই বিভাগেই রয়েছে।
স্পেশ্যালিস্টদের ধরে রাখতে মরিয়া হেলথ সার্ভিস অর্থাৎ স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তার বিভাগ ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি নির্দেশ জারি করে। তাতে বলা হয়, স্পেশ্যালিস্টদের ক্ষেত্রে হেলথ সার্ভিস থেকে এমইএসে যেতে হলে হেলথ সার্ভিসে ন্যূনতম তিন বছর কাজ করতে হবে এবং কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তবে এমইএসে যাওয়া যাবে। এতে ২০১৫-র অগস্ট থেকেই এমইএসে সার্ভিস ক্যাডার থেকে বিশেষজ্ঞ আসা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
২০১৬ সালের ১৪ জুন নয়া নির্দেশিকা জারি করে হেলথ সার্ভিস। সেখানে স্পেশ্যালিস্টদের ব্যাপারে আরও কড়া হয়ে জানানো হয়, হেলথ সার্ভিস থেকে এমইএসে যোগ দিতে চাইলে বিশেষজ্ঞদের আগে ইস্তফা দিতে হবে। অর্থাৎ চাকরির যাবতীয় সিনিওরিটি এবং সুবিধা ছেড়ে তবে এমইএসে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা যেতে পারবেন। কিন্তু এই নিয়ম চালুর ব্যাপারে ওই নির্দেশিকায় ভুলবশত তারা ওয়েস্ট বেঙ্গল সার্ভিস রুল ১৯-এর পার্ট-১-এর কথা বলেছিল। ফলে নির্দেশিকা বাস্তবায়িত হয়নি।
গত ৯ অগস্ট ভুল শুধরে আবার একটি নির্দেশিকা জারি করে হেলথ সার্ভিস। তাতে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল গভর্মেন্ট সার্ভেন্টস কনডাক্ট রুল, ১৯৫৯’ এবং ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল সার্ভিসেস রুলস, ১৯৮০-র রুল ৬ (২)’-এর উল্লেখ করে হেলথ সার্ভিস থেকে জানানো হয়েছে, ইস্তফা না দিয়ে কোনও স্পেশ্যালিস্ট হেলথ সার্ভিস থেকে মেডিক্যাল এডুকেশন সার্ভিসে যোগ দিতে পারবেন না।
এই টানাটানি সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর উক্তি, ‘‘এখন বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন বেশি হচ্ছে। এবং তাঁরা যাতে এক বিভাগেই থাকেন তা নিশ্চিত করতে আইনও রয়েছে। তাই আমরা তা প্রয়োগ করছি।’’ বিভাগের অন্য কর্তারা জানান, গত এপ্রিলে সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের জন্য ২০০ স্পেশ্যালিস্ট নিয়োগ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। আবেদন করেন ২৬ জন। যোগ দেন ৪ জন! মার্চ মাসে হেলথ সার্ভিসেই ১৫১৫ জন বিশেষজ্ঞ নেওয়ার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। তাতে ৩১৮ জনকে নিয়োগ করা যাচ্ছে। এই শোচনীয় অবস্থার জন্য স্পেশ্যালিস্ট ধরে রাখতে মরিয়া স্বাস্থ্য অধিকর্তা এতটা কড়া হয়েছেন।
মেডিক্যাল এডুকেশন বিভাগের প্রধান স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় কী বলছেন? তাঁর জবাব, ‘‘আমাদেরও ব্যাপক সমস্যা। বিশেষজ্ঞ শিক্ষক-চিকিৎসকের প্রচুর আকাল। সরকার জানেও। নাজেহাল হচ্ছি। আর কিছু বলার নেই। ৯ অগস্ট এমইএসে ৪১৭ পদে বিশেষজ্ঞ নেওয়ার জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। দেখা যাক ক’জন আসেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy