Advertisement
E-Paper

মৃত্যুর দায় কে নেবে, উঠছে প্রশ্ন

জেলার চার জনের মৃত্যুতে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে পুরুলিয়ায়।

প্রশান্ত পাল

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০২০ ০১:০০
বিহ্বল: মিলনের মা সুবাসী বাদ্যকর। দুমদুমি গ্রামের বাড়িতে। ছবি: সুজিত মাহাতো

বিহ্বল: মিলনের মা সুবাসী বাদ্যকর। দুমদুমি গ্রামের বাড়িতে। ছবি: সুজিত মাহাতো

চার জনই এলাকায় দিনমজুরি করতেন। মার্বেল কারখানায় পাকা চাকরি শুনে দালালের হাত ধরে গিয়েছিলেন রাজস্থান। প্রায় দু’মাস ‘লকডাউন’-এ আটকে থাকার পরে, এক রকম মরিয়া হয়েই পায়ে হেঁটে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। শনিবার ভোরে উত্তরপ্রদেশে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হল পুরুলিয়ার সেই চার পরিযায়ী শ্রমিকের।

শনিবার ভোর সাড়ে ৩টে নাগাদ উত্তরপ্রদেশের ঔরৈয়ায় দু’টি ট্রাকের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। মৃত্যু হয় একটির যাত্রী ২৩ জন পরিযায়ী শ্রমিকের। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন পুরুলিয়ার চার জন। উত্তরপ্রদেশ পুলিশ পটনাগামী ‘ওয়াল পুট্টি’ বোঝাই ট্রাকে তুলে দিয়েছিল তাঁদের। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, মৃতদের মধ্যে মিলন বাদ্যকর (২১) ও চন্দন রাজোয়াড় (২৮) পুরুলিয়া মফস্সল থানার দুমদুমি গ্রামের বাসিন্দা। অজিত মাহাতোর (৪০) বাড়ি কোটশিলা থানার উপরবাটরি গ্রামে। ওই তিন জন রাজস্থানের জয়পুরের একটি মার্বেল কারখানায় কাজ করতেন। চতুর্থ জনের নাম গণেশ রাজোয়াড় (২০)। তিনি কাজ করতেন জয়পুরেরই অন্য একটি কারখানায়।

জেলার চার জনের মৃত্যুতে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে পুরুলিয়ায়। মিলনের পড়শি শ্রীকান্ত গড়াই বলেন, ‘‘হঠাৎ লকডাউন হয়ে গেল। ছেলেগুলো ফেরারও সময় পেল না। সরকারি অব্যবস্থার মাশুল প্রাণ দিয়ে দিতে হল ওদের।’’ বাঘমুণ্ডির কংগ্রেস বিধায়ক নেপাল মাহাতো বলেন, ‘‘ভয়ানক দিশাহীন অবস্থায় পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে চাইছেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা। কত দিন লকডাউন চলবে, বাড়ি ফেরানোর জন্য কোনও ব্যবস্থা হচ্ছে কি না— কিছুই জানতে পারছেন না তাঁরা। এই মৃত্যুর দায় পুরোপুরি কেন্দ্রীয় সরকারের।’’

বিজেপির পুরুলিয়া জেলা সভাপতি বিদ্যাসাগর চক্রবর্তী অবশ্য বলেন, ‘‘এই মৃত্যু খুবই মর্মান্তিক। রাজ্য সরকার আগেই কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের ফেরানোর ব্যবস্থা করতে পারত। প্রচুর শ্রমিক এখনও বাইরে আটকে রয়েছেন। অবিলম্বে বাকিদের সুরক্ষিত ভাবে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হোক।’’ এ দিন মৃত চার শ্রমিকের বাড়িতে যান পুরুলিয়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো। প্রতিটি পরিবারকে দু’লক্ষ টাকা করে আর্থিক সাহায্যের কথা জানিয়েছেন তাঁরা। দেহ নিয়ে আসার ব্যাপারেও যাবতীয় সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন। মন্ত্রী শান্তিরামবাবুর পাল্টা দাবি, ‘‘অপরিকল্পিত লকডাউন। তার জন্যই এই অবস্থা। রাজ্য সরকার শ্রমিকদের ফেরাতে যথাসম্ভব চেষ্টা করছে। এ সব বলে নিজেদের দায় বিজেপি এড়াতে পারবে না।’’

এ দিন বেলায় দুমদুমি পৌঁছে দেখা গেল, থমথম করছে গ্রাম। মিলনের বাড়ি ওই গ্রামের দাসপাড়ায়। চন্দনের রাজোয়াড়পাড়ায়। পুজোর আগে দু’জন এক সঙ্গে রাজস্থানে কাজে গিয়েছিলেন। মিলনেরা তিন ভাই। তিনি ছিলেন মেজ। ছোট ভাই রাজকিশোরের বয়স বছর দশেক। স্কুলে পড়ে সে। বড় ভাই দেবাশিস রাজস্থানের ওই মার্বেল কারখানায় বছর দেড়েক আগে থেকে কাজ করছেন। তিনি জানান, জায়গাটি জয়পুর জেলার দুদু থানা এলাকায়। ছুটি নিয়ে গত জানুয়ারির মাঝামাঝি গ্রামে এসেছিলেন দেবাশিস। ঠিক ছিল, তিনি ফিরলে মিলন আসবেন। কিন্তু ‘লকডাউন’ ঘোষণা হওয়ায় দু’জনে দু’জায়গায় আটকে পড়েন।

মিলনের বাবা অমৃত বাদ্যকর দিনমজুরি করেন। এ দিন চুপ করে ঘরের দাওয়ায় বসেছিলেন তিনি। মা সুবাসী বাদ্যকরকে তখনও ছেলের মৃত্যু সংবাদ জানানো হয়নি। দেবাশিস বলেন, ‘‘বাবার চিকিৎসার টাকা জোগাড়ের জন্য আমাদের দু’ভাইয়ের ভিন্ রাজ্যে যাওয়া। আট হাজার টাকা মাইনে পেত ভাই। আমাদের কাছে সেটাই অনেক। কিন্তু সে জন্য যে প্রাণটাই চলে যাবে, সেটা জানলে কখনও নিয়ে যেতাম না।’’ তিনি জানান, গত বৃহস্পতিবার ভাইয়ের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল। শনিবার পরিচিত এক জন ফোন করে দুর্ঘটনার খবর জানান।

পরিবারের মধ্যে প্রথম কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন চন্দন। তাঁর বাবা ভিক্ষাকর রাজোয়াড় এবং বড় দাদা আদিত্য রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। মেজ দাদা রাজীব করেন দিনমজুরি। পুরুলিয়ার জেকে কলেজে কলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছিলেন চন্দন। পুজোর সময়ে পড়া ছেড়ে রাজস্থানে কাজে যান। এ দিন মিলনের বাড়ির লোকজনের থেকেই দুর্ঘটনার খবর পান ভিক্ষাকরবাবুরা।

আকস্মিকতায় দুর্ঘটনার কথা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না চন্দনের মা মালতি রাজোয়াড়। আদিত্য জানান, ভাইয়ের সঙ্গে তাঁদের শেষ কথা হয়েছিল বৃহস্পতিবার। ততক্ষণে পায়ে হেঁটে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়েছেন চন্দন। দাদাকে বলেছিলেন, ‘‘লকডাউন মনে হচ্ছে বাড়বে। বেশি দিন এ ভাবে এখানে থাকা যাবে না।’’

মৃত অজিত মাহাতোর তিন মেয়ে, এক ছেলে। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। মেজ মেয়ের বিয়ের কথা চলছে। বছর বারোর ছোট মেয়ে এবং বছর দশেকের ছেলে স্কুলে পড়ছে। স্ত্রী ঊর্মিলা মাহাতো জানান, এলাকায় যা কাজ পেতেন, তা-ই করতেন অজিতবাবু। জানুয়ারির শেষে রাজস্থানে যান। ঊর্মিলা বলেন, ‘‘কোথায় কাজ করতেন জানি না। শুধু বলেছিলেন, রাজস্থানে পাথর কারখানায় পাকা কাজ।’’ তিনি জানান, বৃহস্পতিবার সকালে শেষ বার ফোনে স্বামীর সঙ্গে কথা হয়েছিল। অজিতবাবু স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘‘বাড়ি যাব বলে বেরিয়েছি। আপাতত হাঁটছি। ফোন কোরো না। দরকার হলে আমিই করব।’’ অজিতবাবুর জেঠতুতো দাদা পরীক্ষিৎ মাহাতো জানান, এ দিন সকালে থানায় ডেকে পুলিশ তাঁদের দুর্ঘটনার খবর দেয়।

গণেশ রাজোয়াড় আদতে পুরুলিয়ার জয়পুর ব্লকের ঝালমামড়া গ্রামের বাসিন্দা। বাবা ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করেন। শৈশব থেকেই গণেশরা দুই ভাই পুরুলিয়া মফস্সল থানার বোঙাবাড়িতে মামারবাড়িতে বড় হয়েছেন। মামা বিপ্লব রাজোয়াড় ট্রাক্টর চালান। তিনি জানান, স্থানীয় স্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন গণেশ। তাঁর ভাই কার্তিক ঝাড়খণ্ডে শ্রমিকের কাজ করেন। গণেশও মাস সাতেক আগে রাজস্থানের একটি কারখানায় কাজ নিয়ে যান। এ দিন দুপুরে পরিচিতদের থেকে ভাগ্নের মৃত্যুর খবর পান বিপ্লববাবু। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের বাড়ির সবার খুব আদরের ছেলে ছিল গণেশ। দিদির সামনে কী ভাবে গিয়ে দাঁড়াব, ভেবে কূল পাচ্ছি না!’’

corona virus covid 19 Lockdown
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy