Advertisement
E-Paper

গরুর গায়ের ক্যানভাসে পাসপোর্ট আঁকেন শিল্পী

সীমান্তের অর্থনীতি নাকি চার পায়ে হাঁটে। পাচারের গরুর ক্ষুরে ক্ষুরে টাকা ওড়ে, যার দাপটে গুলিয়ে যায় আইন আর নজরদারির সব হিসেব-নিকেশ। দেখে এল আনন্দবাজার।সীমান্তের অর্থনীতি নাকি চার পায়ে হাঁটে। পাচারের গরুর ক্ষুরে ক্ষুরে টাকা ওড়ে, যার দাপটে গুলিয়ে যায় আইন আর নজরদারির সব হিসেব-নিকেশ। দেখে এল আনন্দবাজার।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৩০

গরু আর গরু!

যত দূর চোখ যায়, বিশাল মাঠ জুড়ে পাল পাল গরু। নানা

সাইজের, নানা রকমের। একটার মুখেও শব্দ নেই। আশপাশে আওয়াজ বলতে শুধু মোবাইলে ফিসফিসানি। ব্যাপারিদের কোড ল্যাঙ্গোয়েজ লাইন ক্লিয়ার, লোড দিচ্ছি, ইত্যাদি। সঙ্গে গালিগালাজ। লোড, মানে গরুদের উদ্দেশে।

পছন্দসই চব্বিশটা গরু কিনে দাম মিটিয়ে ট্রাকে তুলে নেওয়া হল। কেটে নেওয়া হল সরকারি চালানও।

সীমান্তে কারচুপি করে নিত্য দিন বাংলাদেশে হাজার-হাজার গরু পাচারের খবর নতুন কিছু নয়। কিন্তু কী ভাবে, কোন পথ পেরিয়ে আন্তর্জাতিক সীমান্তে রোজ এত গরুর সমাবেশ হচ্ছে, সেই কৌতূহলেই গলায় গামছা, কাঁধে ঝোলা নিয়ে উঠে পড়েছিলাম কল্যাণীর এক গরু-মালিকের ট্রাকে। মালিক নিশ্চিন্ত করেছিলেন, আমার পরিচয় গোপন থাকবে। নিজেও নিশ্চিত হয়েছিলেন, কস্মিন কালে তাঁর নাম কেউ জানবে না। ট্রাক চালকের কাছে আমার পরিচয়, শিক্ষানবিশ খালাসি। দেখা গেল, ছাত্রের মুখে ‘ওস্তাদ’ সম্বোধনে তিনি বিলক্ষণ খুশ।

হুগলির মগরায় সওয়ার হওয়া গেল ওস্তাদের গো-যানে। আপাদমস্তুক ত্রিপলে ঢাকা দশ চাকার বিশাল ট্রাক। বাইরে থেকে বোঝার যো নেই, ভিতরে কী! ড্রাইভারের কেবিনে প্রশস্ত জায়গা। তিনটে ছেলেও আছে। এক জন খালাসি। দু’জন ‘রাখাল।’ তাদের কাজ ট্রাকে গরু ওঠানো-নামানো, পথে দেখভাল।

পান্ডুয়ার দিকে গাড়ি চলল। আগে-পরে সারি সারি ট্রাক। পান্ডুয়ার যেখানে গিয়ে থামলাম, তার নামই গো-হাট। জিটি রোডের বাঁ ধারে পাঁচিল ঘেরা বিশাল তল্লাট। পোশাকি নাম শাহ ফরিদ পশুর হাট। শ’খানেক ট্রাকের ভিড়ে জমজমাট। ওস্তাদ বললেন, “চলো, হাট দেখায়ে আনি।”

চললাম। ট্রাকের সারির পিছনে ছোট টিলা। আসলে গাদা করা খড়-বিচালি। ব্যাক গিয়ারে যার সামনে গিয়ে ডালা খুলে ধরছে একের পর এক ট্রাক। হাটে বিকোনো গরুর দল বিচালি খেতে খেতে টিলায় উঠে সোজা সেঁধিয়ে যাচ্ছে তার পেটে। টিলা পেরিয়ে ও-পারে নামতেই সেই অভূতপূর্ব দৃশ্য। গরু আর গরু। যেন দিগন্ত বিস্তৃত গো-সমুদ্র!

বাস্তবিকই ল্যাজেগোবরে হয়ে যাই। ওস্তাদ বলেন, ‘‘এক হাটেই ঘাবড়ে গেলে! এমন কত আছে।” পাশ থেকে মোবাইল থামিয়ে সন্দিগ্ধ প্রশ্ন ছুড়ে দেয় এক ব্যাপারি “মালটা কে?” ওস্তাদ সামলায় ‘‘গেস্ট, গেস্ট। গরুর হাট দেখতে এসেছে।’’ আলাপ হয় দালাল মহসিনের সঙ্গে। তার মুখে জানা গেল, তিন রকমের গরু আছে। বড়গুলোর নাম আন্ডু। তারা কন্টেনারে চড়ে যায়। মাঝারি গরু হল দামড়া। ক্ষীণতনু, রুগ্ণদের ‘ছাট’ নামে ডাকা হয়। শুনলাম, পান্ডুয়া ছাড়াও ইলামবাজার, মেমারি, পূর্ব মেদিনীপুর, এমনকী ঝাড়খণ্ডের ঘোড়াধরা হাট থেকে এন্তার গরু কিনে ও-পারে পাচার হচ্ছে।

ক্যাবলার মতো প্রশ্ন করে বসি, “ধরা পড়ার ভয় নেই?”

হো-হো করে হেসে ওঠে মহসিন। দু’আঙুলের মুদ্রায় বোঝায়, সবই পয়সার খেল। আর তাতে কাজ না-হলে? “সোজা খাল্লাস।”

মনে পড়ে যায়, গরু পাচারঘটিত গোলমালে গত ক’বছরে কত

রক্ত ঝরেছে। গুলি, বোমা, খুন, পাল্টা খুন। গা ছমছম করে ওঠে। ওস্তাদের কাছে আবদার ধরি, কন্টেনার দেখব। আর্জি মঞ্জুর।

ট্রাকের পিঠে ইস্পাতে ঘেরা বিশাল বাক্স। ভিতরটা দেখে চোখ ছানাবড়া! সত্যিকারের ঘাসের সবুজ গালিচা বিছানো! যেন বারাসত স্টেডিয়ামের অ্যাস্ট্রোটার্ফ! ঘেরা চৌবাচ্চায় জল। দু’পাশে বিচালির স্তূপ। গোবর জমলেই তুরন্ত সাফ হয়ে যাচ্ছে। ভিআইপি আন্ডুদের জন্য দস্তুরমতো ফাইভ স্টার আতিথেয়তা! কন্টেনারের ড্রাইভার শিবা জানায়, “এদের অনেকে বাংলাদেশ হয়ে চলে যাবে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মায়ানমার। এদের পাসপোর্ট আছে।”

তাজ্জব কথা! গরুর পাসপোর্ট?

ওস্তাদ আলাপ করিয়ে দিল মনোহর গাজির সঙ্গে। গো-পাসপোর্ট লিখিয়ে। মাদ্রাসাশিক্ষিত মনোহর আদতে শিল্পী মানুষ। ভোটের দেওয়ালে গরমাগরম স্লোগান লিখতেন। নির্বাচন কমিশনের কড়াকড়ির পরে গরুর চামড়াই এখন তাঁর ক্যানভাস। তাঁর তুলির আঁচড়ে গরুর গায়ে ফুটে ওঠে নানা নম্বর, সাঙ্কেতিক শব্দ। যেমন ‘নাইন’ কিংবা ‘সি-এম।’ যা দেখেই শুল্ক দফতর থেকে সীমান্তরক্ষী সকলে বুঝে যায়, এই গরুর মালিক কোন মাফিয়া। “এটাই পাসপোর্ট। পারাপারের সমস্ত কড়ি মাসকাবারি হিসেবে অগ্রিম জমা থাকে।” আনকোরা খালাসিকে ওস্তাদ বুঝিয়ে দিলেন জলের মতো প্রাঞ্জল করে।

চালানের গায়ে মার্কা পড়ছে। দেখেই বোঝা যাবে, কোন চক্রের গরু।

সন্ধে হব হব। শান্তিপুরি ব্যাপারির থেকে কেনা দু’ডজন দামড়াকে গাড়িতে তুলে নিল দুই রাখাল। কেনা হল ১১০ টাকার কাঁচালঙ্কা বাটা। গাড়িতে কেউ বেগড়বাঁই করলেই চোখে লাগিয়ে দেওয়া হবে। ট্রাকে তোলার সময় কোনও কোনও বেয়াদপের পিছনে রুল ঢুকল। আঁতকে উঠতেই রাখালের আশ্বাস, চোখ বা পায়ু অকেজো হলেও ওদের দাম কমবে না।

লোডিং শেষ। এ বার রওনা। হাটের মুখে শাসকদলের শ্রমিক সংগঠনের পার্টি অফিস। সেখানে টাকা মিটিয়ে ওস্তাদ গাড়ি স্টার্ট দিলেন। আশপাশে টাটা সুমো, স্করপিও-র মতো গাড়িও। তাতে চেপেও নাকি গরু যাচ্ছে! ওস্তাদ বলেন, “সুমোয় মানুষ তুলে ভাড়া খাটলে পুলিশ কেস দেয়। কিন্তু দু’-চারটে গরু তুললে জামাই আদর! পয়সা মিলবে যে!”

গরুর পায়ে পায়ে কত পয়সা উড়ছে, টের পেতে দেরি হল না।

(চলবে)

india bangladesh border cow trafficking arunaksha bhattacharya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy