Advertisement
E-Paper

অ্যাডমিট কার্ড আগলে টুম্পা বলছে, পরীক্ষা দেবই

আমপানের দাপটে টুম্পাদের ঘরবাড়ি ধূলিসাৎ। শুধু দাঁড়িয়ে আছে মাটির বাড়ির ভিতটুকু। আসবাবপত্র ছত্রখান।

নির্মল বসু ও সীমান্ত মৈত্র

শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০২০ ০৪:৪৮
প্রত্যয়ী: ধূলিসাৎ বাড়ি। উচ্চ মাধ্যমিকের অ্যাডমিট কার্ড আগলে বসে টুম্পা রায়। মঙ্গলবার বাগদায়। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক

প্রত্যয়ী: ধূলিসাৎ বাড়ি। উচ্চ মাধ্যমিকের অ্যাডমিট কার্ড আগলে বসে টুম্পা রায়। মঙ্গলবার বাগদায়। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক

ছেঁড়া খাতা, দুমড়ে যাওয়া বই আঁকড়েই লড়ে যাচ্ছে টুম্পা। আর বলছে, ‘‘অ্যাডমিট কার্ডটা যখন বেঁচে গিয়েছে, আমার পরীক্ষা দেওয়া কেউ আটকাতে পারবে না।’’

উত্তর ২৪ পরগনার বাগদার মেহেরানি এলাকায় থাকে টুম্পা রায়। উচ্চ মাধ্যমিক চলছে তার। মাঝপথে বাদ সাধে করোনা। পরীক্ষা পিছিয়ে যায়। অনেকের মতো খানিকটা দমে গিয়েছিল টুম্পাও। কিন্তু তখনও জানত না, আরও কত বড় বিপত্তি অপেক্ষা করে আছে।

আমপানের দাপটে টুম্পাদের ঘরবাড়ি ধূলিসাৎ। শুধু দাঁড়িয়ে আছে মাটির বাড়ির ভিতটুকু। আসবাবপত্র ছত্রখান। নাগাড়ে বৃষ্টিতে বালিশ-তোষক, ঠাকুরের আসন, বাক্স-প্যাঁটরা তো বটেই, বইখাতাও ফর্দাফাই। সঙ্গে গিয়েছে গৃহশিক্ষকের নোটস। টুম্পা বলে, ‘‘বিপদ আসতে পারে বুঝে বইখাতা টেবিলের সঙ্গে শক্ত করে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছিলাম। কিন্তু ঘরটাই তো উড়ে গেল!’’ চোয়াল শক্ত করে কিশোরী বলে, ‘‘বন্ধুদের কাছ থেকে নোটস আবার জোগাড় করে ফেলতে পারব। কথা হয়ে গিয়েছে। আমাদের মতো সংসারে অনেক কষ্ট করে পড়া চালিয়ে যাচ্ছি। কোনও ভাবেই একটা বছর নষ্ট করতে পারব না।’’

কুরুলিয়া হাইস্কুল থেকে এ বার উচ্চ মাধ্যমিক দিচ্ছে কলা বিভাগের ছাত্রী টুম্পা। ভূগোল এবং সংস্কৃত পরীক্ষা বাকি এখনও। টুম্পা জানায়, গত বুধবার রাত ১২টা নাগাদ ঝড়টা প্রবল আকার নেয়। ঘরের টিন উড়িয়ে নিয়ে গেল। বাবা সহদেবের সঙ্গে পাশে পিসির বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল টুম্পারা। সেখানেও বিপত্তি। পিসি রাধারানির বাড়ির একাংশও ভেঙে পড়ে। সকলে ছুটে গিয়ে আর এক পড়শির বাড়িতে আশ্রয় নেয়।

সকালে ঘরবাড়ি আর হারিয়ে যাওয়া খাতাপত্রের শোকে চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি মেয়েটি। কিন্তু মন শক্ত করে নেয় দ্রুত। শুক্রবার থেকে রোদ্দুরে বই শুকোতে দিতে শুরু করেছে। সে সব এখন খানিক পড়ার মতো হয়েছে বলেও জানাল।

আরও পড়ুন: ‘রাক্ষুসে নদীর বাঁধ সারানোর কথা কেউ ভাবল না!’

আপাতত পিসির বাড়ির অক্ষত অংশে আশ্রয় নিয়েছে টুম্পারা। ভাই সমীর কুরুলিয়া হাইস্কুলে দশম শ্রেণির ছাত্র। তারও বইপত্র নষ্ট হয়েছে। মঙ্গলবার টুম্পার মা বিশাখা বলেন, ‘‘অনেক কষ্ট করে ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা শেখাচ্ছি। ঘূর্ণিঝড় সব শেষ করে দিল। একটা ত্রিপলও পর্যন্ত পাইনি। চেয়েচিন্তে খাওয়া জুটছে।’’

আমপানের রাতে ২টো নাগাদ বাড়ি ছেড়েছিল আসগর আলি সর্দার। হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের বাঁকড়া গ্রামে ইছামতীর ধারে বাড়ি তাদের। হিঙ্গলগঞ্জ হাইস্কুলের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী আসগরের ইতিহাস আর সংস্কৃত পরীক্ষা এখনও বাকি। হাতের সামনে থাকা কিছু বইখাতা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল।

আসগরের কথায়, ‘‘রাতের দিকে গ্রামে জল ঢুকতে শুরু করে। ত্রাণ শিবিরে আগেই যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। অন্ধকারের মধ্যেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি সকলে। সঙ্গে করে কিছু বইখাতা বের করতে পেরেছিলাম। তবে রাস্তায় সে সব ভিজে একসা।’’

মঙ্গলবার গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, যত দূর চোখ যায়, শুধুই জল। চারদিকে ভাসছে দরমার বেড়া, আর অ্যাসবেস্টসের চাল। আসগরের বাবা আজিজ বলেন, ‘‘সুন্দরবনের ছেলেমেয়েদের অনেক সমস্যা সামলে পড়াশোনা চালাতে হয়। ঘরবাড়ি সব ভেসেছে। এই অবস্থায় সরকারি সাহায্য ছাড়া ওরা কী করে পড়াশোনা চালাতে পারবে জানি না।’’

বাঁশতলি রাউতপাড়া এলাকায় দেখা হল সুস্মিতা বিশ্বাসের সঙ্গে। রোদে বই-খাতা শুকোতে দিয়েছিল। খেজুরবেড়িয়া স্কুল থেকে এ বার সে-ও উচ্চ মাধ্যমিক দিচ্ছে। পরীক্ষা শেষ হয়নি। গৌড়েশ্বর নদীর বাঁধ ভাঙা জলে বাড়ি ঘর ভেসে গিয়েছে। একই কারণে চিন্তিত সন্দেশখালির ন্যাজাটের নেতাজি পল্লির দেবপ্রিয়া মুখোপাধ্যায়। বাঁধ ভেঙে সব শেষ। পরীক্ষা দিতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সংশয়ে।

এত দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগের মধ্যেও কানে ভাসে টুম্পার কথা। মাকে সান্ত্বনা দিয়ে মেয়ে বলে, ‘‘দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি পরীক্ষায় ভাল রেজাল্টই করব। কিচ্ছু ভেবো না।’’

Cyclone Amphan Bagda
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy