Advertisement
E-Paper

কফিনে আছড়ে পড়লেন মা

পৌনে চারটে নাগাদ পাড়ায় ঢুকল নাকাশিপাড়া থানার একটি গাড়ি। তার পিছনে ভারত-তিব্বত সীমান্ত পুলিশের গাড়ি এবং পিছনের তৃতীয় গাড়িতে জাতীয় পতাকায় ঢাকা কফিনে মাসাদুল রহমান।

সন্দীপ পাল

শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ০১:৩৫
নিহত আইটিবিপি কনস্টেবল মাসাদুল রহমানের দেহ কফিনে, সামনে মা হানিফা বিবি। বৃহস্পতিবার নাকাশিপাড়ার বিলকুমারী গ্রামে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

নিহত আইটিবিপি কনস্টেবল মাসাদুল রহমানের দেহ কফিনে, সামনে মা হানিফা বিবি। বৃহস্পতিবার নাকাশিপাড়ার বিলকুমারী গ্রামে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

দোতলা পাকা বাড়ির নীচের বারান্দায় পাথরের মতো বসেছিলেন হানিফা বিবি। দু’ চোখ দিয়ে জলের স্রোত বইছে। তাঁকে ঘিরে রয়েছেন পরিবারের মহিলারা। সামনের উঠোনে একটা চেয়ারে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে বসে মারফত আলি শেখ। দু’জনেই প্রতীক্ষা করছিলেন সেজ ছেলে মাসাদুল রহমানের মৃতদেহের। বৃহস্পতিবার বেলা তখন প্রায় তিনটে। বিলকুমারীর গ্রামের মধ্যপাড়ার রাস্তার দু’পাশে তখন থিকথিকে ভিড়। পাড়ার ভিতর, বাজারে, মোড়ে একাধিক জটলা। সর্বত্রই প্রতীক্ষা। কখন এসে পৌঁছবে গ্রামের ছেলে।

পৌনে চারটে নাগাদ পাড়ায় ঢুকল নাকাশিপাড়া থানার একটি গাড়ি। তার পিছনে ভারত-তিব্বত সীমান্ত পুলিশের গাড়ি এবং পিছনের তৃতীয় গাড়িতে জাতীয় পতাকায় ঢাকা কফিনে মাসাদুল রহমান। বাড়ির উঠোনে কফিন নামানো হতেই ছুটে এসে তার উপর আছড়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন হানিফা। ছেলেকে এই অবস্থায় দেখতে চাইছিলেন না মারফত আলি। পরিজনেরাই তাঁকে ধরে-ধরে নিয়ে এল। বৃদ্ধ কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন পাশে।

তখনও মাসাদুলের আত্মঘাতী হওয়া এবং তার আগে গুলি চালিয়ে পাঁচ সহকর্মীকে মারার তথ্য থেকে সরে আসেননি আইটিবিপি কর্তৃপক্ষ। তাই আশপাশ থেকে ভেসে আসছিল পরিজন ও গ্রামবাসীদের অবিশ্বাসের কথা। শান্ত-ভদ্র ছেলে এমন করতেই পারে না, এর পিছনে অন্য কোনও রহস্য রয়েছে— এমন অনেক টুকরো মন্তব্য শোনা যাচ্ছিল। তীব্র শোক আর কান্নার মধ্যেও ঠেলে বেরিয়ে আসছিল পরিজনদের রাগ। কখনও মাসাদুলের ভাইয়েরা আবার কখনও মা ফুঁসে উঠে জানাচ্ছিলেন, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁরা তদন্তের আবেদন জানাবেন। মাসাদুল অন্যদের মেরে আত্মঘাতী হয়েছেন এই তথ্য তাঁরা মানেন না। ঘটনাচক্রে এর কয়েক ঘণ্টা পরেই দিল্লিতে আইটিবিপি-র জনসংযোগ আধিকারিক বিবেককুমার পাণ্ডে মাসাদুলের আত্মঘাতী হওয়ার কথা খণ্ডন করে জওয়ানদের মধ্যে তীব্র তর্কের জেরে গুলির লড়াইয়ের কথা জানিয়েছেন এবং দাবি করেছেন, সহকর্মী সুরজিৎ সরকারের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে মাসাদুলের।

এ দিন মাসাদুলের দেহ তাঁর বাড়ি আনার পরেই সকলের চোখে পড়ে, মাসাদুলের বাঁ বগলের নীচে বুলেটের ক্ষতচিহ্ন। সেখানে থেকে রক্ত চুঁইয়ে কালচে হয়ে শুকিয়ে রয়েছে। এর পরেই পরিজনেরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে প্রশ্ন তোলেন, ‘‘কেউ নিজে নিজের শরীরের ওই অংশে গুলি করে আত্মঘাতী হতে পারে?’’ চোখে জল নিয়েই মেজো ভাই মিজানুর রহমানের বক্তব্য ছিল, ‘‘ওর দেহ দেখলাম। বগলের নীচে গুলির ক্ষত। রক্ত লেগে আছে। আমরা এর তদন্ত চাই। যা প্রচার করা হচ্ছে তা আমরা মানছি না।’’ মাসাদুলের ছোট ভাই মাজারুল রহমান সিআরপিএফ জওয়ান। ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে ছুটি নিয়ে এসেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ওর ছুটি নিয়ে বাড়ি আসার কথা ছিল। যতদূর খবর পেয়েছি, ওর আগ্নেয়াস্ত্র জমা পড়ে গিয়েছিল। তা হলে কী করে সেটা চালিয়ে ও পাঁচ সহকর্মী ও নিজেকে মারতে পারে?’’

মাওবাদী অধ্যুষিত ছত্তীসগঢ়ের নারায়ণপুরের কাদেনা গ্রামে সেনা ছাউনিতে ছিলেন মাসাদুল। তাঁর মৃত্যুর খবর বুধবার দুপুরে নদিয়ার গ্রামে এসে পৌঁছোয়। খবরটা জানার পর থেকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না মাসাদুলের মা হানিফা বেগম, বাবা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কনস্টেবল মারফত আলি শেখ এবং গ্রামের অনেকেই। সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা গ্রামে গেলে তাঁদের সামনে বার-বার সে কথা বলেওছিলেন তাঁরা।

মাসাদুলের পাশাপাশি সুরজিৎ সরকারের দেহও এ দিন বিকেলে পূর্ব-বর্ধমানের পূর্বস্থলীর শ্রীরামপুরে তাঁর বাড়িতে পৌঁছোয়। নিহত আর এক বাঙালি জওয়ান বিশ্বরূপ মাহাতোর দেহ এ দিন রাঁচি পৌঁছেছে। পুরুলিয়া জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, আজ সকালে আড়শার কাঁটারি গ্রামে তাঁর দেহ পৌঁছনোর কথা। সুরজিৎ সরকারের দেহ সন্ধ্যায় দেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার সময়েও ছেলেকে ছাড়তে রাজি হচ্ছিলেন না মা পার্বতী সরকার। বারবার বলছিলেন, ‘‘আমার সব শেষ হয়ে গেল।’’ বাবা পীযূষ সরকার বলছিলেন, ‘‘মঙ্গলবার রাত ৯টা নাগাদ ছেলের সঙ্গে কথা হল। একদম স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলেছিল। তার পরে কী থেকে কী হয়ে গেল জানি না।’’ বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত আইটিবিপি-র তরফে তাঁদের ওই ঘটনা নিয়ে বা ছেলের মৃত্যু নিয়ে কিছু জানানো হয়নি বলেও তাঁদের দাবি। এ দিন দেহ গ্রামে সুরজিতের দেহ আনার সময়ে হাজির ছিলেন মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ।

অদ্ভুত সমাপতনে পাশাপাশি দুই জেলার ছেলে মাসাদুল ও সুরজিতের শেষকৃত্য বৃহস্পতিবার রাতে সম্পন্ন হল নদিয়াতেই। মাসাদুলের তাঁর নিজের গ্রামের কবরখানায়। আর সুরজিতের নবদ্বীপ শ্মশানে।

সহ প্রতিবেদন— কেদারনাথ ভট্টাচার্য

ITBP Masudur Rahman Suicide Murder
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy