রাত ১২টা বেজে গিয়েছিল। মেয়েটা ঘুমোয়নি। তার আধো আধো কথা শুনতে শুনতেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে এসেছিল সমীর মুর্মুর। মেয়েটা শেষ বার মায়ের বুকের দুধ খেয়েছিল রাত দেড়টা নাগাদ। ভোর রাতে প্রবল শ্বাসকষ্ট। দেড় বছরের সন্তান সুস্মিতাকে কোলে নিয়ে গ্রামের রাস্তা ধরে ছুটেছিলেন সমীরের বৌ চম্পা। বড় রাস্তা থেকে গাড়ি ধরে হাসপাতাল পৌঁছতে হবে! চলতি বছরের জুলাই মাস। হাঁটু পর্যন্ত কাদা। ছুটতে গিয়ে বার বার আছাড়। তবু এক মুহূর্তের জন্য মেয়েকে আলাদা করেননি।
সমীর বললেন, “এ গ্রামে তো গাড়ি ঢোকে না। কারও কিছু হলে সবাই খাটিয়ায় চাপিয়েই নিয়ে যায়। সেই রাতে রাস্তার অবস্থা এমন যে খাটিয়াতেও তোলা যায়নি। কোলে নিয়েই দৌড়তে হয়েছিল।’’ চম্পার বুকে জড়ানো অবস্থাতেই মেয়েটা মারা যায়। সময়ে অক্সিজেন পেলে কি বেঁচে যেত বাচ্চাটা? এক চিলতে ঘরের দাওয়ার বসে কান্নায় গলা বুজে আসে ঢালাই শ্রমিক সমীরের।
জনহিতকর নানা প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দের পাশাপাশি এ এক অন্য ছবি। যা জুড়ে রয়েছে এমন অজস্র গ্রাম, যেখানে বাসিন্দারা অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতাল দূরে থাক, স্বাস্থ্যকেন্দ্র পর্যন্তও পৌঁছানো যায় না। পল্লি চিকিৎসক বা চলতি কথায় হাতুড়ে ডাক্তাররাও গ্রামে ঢুকতে অস্বীকার করেন। বলে দেন, ‘‘ও গ্রামে জীবন বাঁচাতে গেলে নিজের জীবন নিয়েই টানাটানি পড়বে।’’ বর্ষায় হাঁটু পর্যন্ত ডুবে থাকা রাস্তা নরকের চেহারা নেয়। আর অন্য সময়ে খানাখন্দে ভরা রাস্তায় গাড়ি চলে না। ছুটতে গেলে হোঁচট। কেউ অসুস্থ হলে গ্রামের বাসিন্দারা তাঁকে খাটিয়ায় চাপিয়ে নিয়ে যান গ্রামের বাইরে, চিকিৎসার জন্য। আর যেতে না পারলে বিনা চিকিৎসাতেই...।
কলকাতা থেকে গাড়িতে পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা পৌঁছতে লাগে ঘণ্টা তিনেক। সেখান থেকে লোয়াদার কাঁকড়া-মোহনপুর বড় জোর ১৫ কিলোমিটার। কিন্তু সে অন্য পৃথিবী।
শীতেও চলাচলের অযোগ্য ডেবরার কাঁকড়া-মোহনপুরের রাস্তা। —নিজস্ব চিত্র।
একটি বাঁশের খাটিয়াই তার মানচিত্র।
ঘরে চাল বাড়ন্ত হতে পারে।
বাচ্চার দুধটুকুও না জুটতে পারে। কিন্তু ওই চার পায়াটিকে কমজোরি হতে দিতে চান না গ্রামের মানুষ। কারণ, এটিই তাঁদের বাঁচার অবলম্বন। বাঁচার, না কি বাঁচতে চাওয়ার? কারণ, সব সময়ে খাটিয়াও শেষরক্ষা করতে পারে না। সুস্মিতাকে খাটিয়ায় চড়ানোর ব্যবস্থাটুকুও করা যায়নি। আর খাটিয়ায় চড়িয়েও বাঁচানো যায়নি সখী সরেনের জামাই বাদল মান্ডিকে।
মোহনপুর গ্রামের জামাই বাদল অনেক দিন ভুগছিলেন। হাসপাতালে থেকে সুস্থ হওয়ার পরে বিশ্রামের জন্য শ্বশুরবাড়ি আসেন। কিছু দিনের মাথায় আবার শরীর খারাপ। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার। খাটিয়ায় চাপিয়ে হাসপাতাল যাওয়ার পথেই মৃত্যু। বাড়ি থেকে বেরনোর আগে সখীর হাতে ভাত খেয়েছিলেন জামাই। “অন্য দিনের চেয়ে আরও খানিকটা বেশি ভাত চেয়েছিল। বুঝিনি সেটাই শেষ খাওয়া ওর।” আঁচলে চোখ মোছেন বৃদ্ধা। ছ’মাস আগে সেই ঘটনার পর থেকেই শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনা সইতে হচ্ছে সখীর মেয়ে পুতুলকে। সখী বলেন, “এই রাস্তাই আমাদের সব খাবে।”
মোহনপুর গ্রাম থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ডেবরায় সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল। খাটিয়ায় চাপিয়ে বড় রাস্তায় এসে সেখান থেকে গাড়ি ধরবার আগেই বহু ক্ষেত্রে ভাল-মন্দ কিছু হয়ে যায়। বছরের পর বছর এ ভাবেই চলে। তাই পথের ধারে ধুলো মেখে খেলছিল যে শিশু, তার দিকে তাকিয়ে অসহায় বাবাও বলতে পারেন, “আজ আছে, কাল নেই।”
সুস্মিতা, বাদলের মৃত্যুর পরে বিডিও-কে দরখাস্ত দিয়েছিলেন গ্রামবাসীরা। বিডিও এক মাসের মধ্যে রাস্তা সারানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই সময়সীমা পেরিয়েছে অনেক আগেই। রাস্তায় একটা ইটও পড়েনি। বিডিও প্রিয়ব্রত রাঢ়ী বললেন, “সব রাস্তাই পথশ্রী প্রকল্পে ধরা আছে। পথশ্রী-র চতুর্থ পর্যায়ের টেন্ডার শুরু হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যেই কাজ শুরু হবে।”
কিন্তু যত দিন তা না হয়, তত দিন রাস্তা মেরামতির কাজটাও কেন হচ্ছে না? স্থানীয় পঞ্চায়েত তাদের তহবিলের টানাটানির কথা বলেছে। “টাকা এলেই কাজ শুরু হবে।” কীসের টাকা, কবে আসবে, সে সব প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই প্রতিনিধিদের কাছে। শেখানো বুলির মতো তাঁরাও পথশ্রীর গল্পই শুনিয়েছেন। গ্রামবাসীরা অবশ্য বলছেন, ওই গল্পে তাঁরা আগেও ভুলেছেন। যেমন মোহনপুর থেকে চার কিলোমিটার দূরে মলিঘাটি গ্রাম পঞ্চায়েতের সাকিরদায় পাঁচ বছর আগে পথশ্রী প্রকল্পের শিলান্যাস হয়ে পড়ে রয়েছে। সাকিরদা মোড় থেকে সমাজপাতা পর্যন্ত সাড়ে চার কিলোমিটার রাস্তা। ফি বছর রাস্তা তৈরির স্বপ্ন দেখানো হয়। দুর্ভোগ বদলায় না।
কাদারাস্তায় খাটিয়া ভরসা। —নিজস্ব চিত্র।
ঘুরতে ঘুরতেই পৌঁছে গিয়েছিলাম কাঁকড়া শিবরাম প্রাথমিক সুস্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সুনসান চারদিক। রক্তচাপ মাপতে আর জ্বরের ওষুধ নিতে এসেছেন দু’জন। এক জন নার্স (অগজ়িলারি নার্স মিডওয়াইফ) তাঁদের সঙ্গে কথা বলছেন। এমবিবিএস ডাক্তার রয়েছেন। কোনও কাজ নেই। রোগীই পৌঁছতে পারেন না বেশির ভাগ দিন। বললেন, “এটা তো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। কেউ আসে না। কেউ মনেও রাখে না। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের রাস্তাই এমন যে বেশিরভাগ রোগী এখানে পৌঁছোনোর ধকলটাই নিতে পারেন না। বহু বার বহু জায়গায় চিঠি লেখা হয়েছে। কোনও জবাব আসেনি।” কাঁকড়া হরপ্রসাদ থেকে হরিণাগেরিয়া যাওয়ার রাস্তায় দেখা বাসিন্দা শক্তিপদ মণ্ডলের সঙ্গে। বললেন, "এ গ্রামে কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে প্রথমেই ধরে নেওয়া হয় সে আর বাঁচবে না।’’
অ্যাম্বুল্যান্স আসে না। বাইকও এমন লাফাতে থাকে, অসুস্থ মানুষের এমনিতেই প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। বর্ষায় রাস্তার কাদায় এমন ভাবে চটি আটকে যায় যে কাদা ঠেলে তাকে বার করা যায় না। গ্রামের এক বৃদ্ধ বললেন, ‘‘আশপাশে অনেক গ্রামেই এই অবস্থা। আমরা সবটা মেনেই নিয়েছিলাম। কিন্তু মোহনপুরের বাচ্চাটার চলে যাওয়া কিছুতেই মানতে পারছি না। এ বার ‘কড়ক ছাপ’ দিতে হবে।’’
সেটা কী? কাউকে মারধরের পরিকল্পনা? জিভ কাটলেন বৃদ্ধ। “না না, ও সব না। যারা মিথ্যা কথা বলে আমাদের বছরের পর বছর অপেক্ষায় রেখেছে, তাদের এ বার এই তল্লাটে দেখলে খাটিয়ায় চাপিয়ে ছুটব। খানাখন্দে ভরা রাস্তায় খাটিয়ায় চেপে যেতে কেমন লাগে, এক বার অন্তত বুঝুক। বাবুদের কষ্ট হলে, তবেই রাস্তা হবে। হবেই।”
(চলবে)
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)