Advertisement
০২ মে ২০২৪

এক জামিনের অপেক্ষায় ‘ম্যাডাম’

তাঁর বিরুদ্ধে মামলা ছিল ১৯৩টি। ১৯২টিতে জামিন হয়ে গিয়েছে। মুক্তির স্বাদ নেওয়ার জন্য তাই শুধু একটি মামলায় জামিনের অপেক্ষায় রয়েছেন সারদা অর্থ লগ্নি সংস্থার ‘সেকেন্ড ইন কম্যান্ড’ দেবযানী মুখোপাধ্যায়। প্রতীক্ষার প্রহর গোনা চলছে দমদম সেন্ট্রাল জেলের কুঠুরিতে বসে। ঘনিষ্ঠ মহলে ‘ম্যাডাম’ জানিয়ে রেখেছেন, জেল থেকে বেরিয়ে ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় মুখ খুলবেন।

দেবযানী মুখোপাধ্যায়

দেবযানী মুখোপাধ্যায়

শুভাশিস ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৪:২১
Share: Save:

তাঁর বিরুদ্ধে মামলা ছিল ১৯৩টি। ১৯২টিতে জামিন হয়ে গিয়েছে।

মুক্তির স্বাদ নেওয়ার জন্য তাই শুধু একটি মামলায় জামিনের অপেক্ষায় রয়েছেন সারদা অর্থ লগ্নি সংস্থার ‘সেকেন্ড ইন কম্যান্ড’ দেবযানী মুখোপাধ্যায়। প্রতীক্ষার প্রহর গোনা চলছে দমদম সেন্ট্রাল জেলের কুঠুরিতে বসে। ঘনিষ্ঠ মহলে ‘ম্যাডাম’ জানিয়ে রেখেছেন, জেল থেকে বেরিয়ে ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় মুখ খুলবেন।

সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের একদা ‘ছায়াসঙ্গিনী’র জীবনযাত্রা, চালচলন আমূল বদলে গিয়েছে গত সাড়ে তিন বছরের কারাবাসে। সারদার রমরমার পর্বে কর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন প্রবল প্রতাপশালী ‘ম্যাডাম।’ জেলেও তা-ই। তবে মহিলা কয়েদিদের ইংরেজির শিক্ষিকা হিসেবে।

সারদা কেলেঙ্কারিতে দেবযানীর বিরুদ্ধে ১৯৩টি মামলার ১৯১টি রুজু করেছিল রাজ্য সরকার। দু’টো সিবিআই। রাজ্যের মামলার সবগুলোতেই জামিন মিলেছে। সিবিআইয়ের ‘সারদা রিয়েলটি’ সংক্রান্ত মামলাতেও মিলেছে। বাকি শুধু ‘সারদা গ্রুপ অব কোম্পানিজ’-এর অন্য মামলাটি। ‘‘এতেও সুপ্রিম কোর্টে জামিনের আর্জি জানানো হয়েছিল। জামিন হয়নি। ফের আবেদন করা হবে,’’ বলছেন দেবযানীর কৌঁসুলি অনির্বাণ গুহঠাকুরতা। সিবিআই গোয়েন্দাদেরও বক্তব্য, গত তিন বছরে দেবযানী তদন্তে বিলক্ষণ সাহায্য করেছেন। যাবতীয় প্রশ্নের পরিষ্কার জবাব দিয়েছেন। তদন্তকারীদের বিপথে চালনার চেষ্টা করেননি।

শেষ মামলায় জামিন নিয়ে মেয়ে কবে বাড়ি আসে, ঢাকুরিয়া স্টেশন রোডের ফ্ল্যাটে বসে তার দিন গুনছেন মা সর্বাণী মুখোপাধ্যায়ও। তাঁকে ও তাঁর স্বামী মোহন মুখোপাধ্যায়কে গত তিন বছরে বিস্তর ঝড়-ঝাপটা সইতে হয়েছে। সর্বাণীদেবীর কথায়, ‘‘জেলে বহু বার দেখা করতে গিয়েছি। সারদার ব্যাপারে কখনও মুখ খোলেনি। মাথা নামিয়ে বলেছে, বেরিয়ে সব জানাব।’’

পরিবার সূত্রেই খবর, সারদা কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পরে, ২০১৩-র ১৮ এপ্রিল সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে ফেরার হয়ে যান দেবযানী। তখন পুলিশ বেশ ক’বার সর্বাণীদেবীর ফ্ল্যাটে কড়া নেড়ে যায়। ভয়ে ওঁরা সিঁটিয়ে থাকতেন। ২২ এপ্রিল গভীর রাতে সর্বাণীদেবীর মোবাইলে অজানা নম্বর ভেসে ওঠে। ফোন ধরতে শোনা যায় কাঁপা কাঁপা গলা— ‘‘মা, আমার খুব বিপদ। হয়তো খুন হয়ে যাব। সোনমার্গের হোটেলে রয়েছি।’’ ফোন কেটে যায়। সকালে দেবযানীর মা-বাবা পুলিশে যোগাযোগ করেন।

পরের ঘটনা ইতিহাস। ওই ফোনের সূত্র ধরে ২৩ এপ্রিল কাশ্মীরের সোনমার্গে সুদীপ্ত, দেবযানী ও তাঁদের গাড়িচালক অরবিন্দ চৌহানকে গ্রেফতার করে রাজ্য পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল। সিবিআই-ও মনে করে, দেবযানীর ফোনের সুবাদেই সুদীপ্তর নাগাল পাওয়া সম্ভব হয়েছিল।

কারাবাসের সিংহভাগ দমদম সেন্ট্রাল জেলে কেটেছে দেবযানীর। ইংরেজির এমএ জেলেও ইংরেজি চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন। আগ্রহী সহবন্দিদের নিয়মিত পড়াচ্ছেন। ‘ইংরেজি ম্যাডাম’-এর জনা তিরিশেক ছাত্রী জুটেছে। এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘কয়েক জন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীকে তো রীতিমতো রুটিন বেঁধে পড়িয়েছেন!’’

তবে দেবযানীর দীর্ঘ কারা-জীবনে সুদীপ্ত সেনের কোনও অস্তিত্ব নেই। সুদীপ্তর ঠিকানা আলিপুর সেন্ট্রাল জেল। রাজ্য ও সিবিআই মিলে তাঁর বিরুদ্ধে দু’শোর বেশি মামলা। অধিকাংশে জামিন মঞ্জুর হলেও সারদা-কর্ণধার কোনও জামিনদার পাননি। দেবযানীর সঙ্গে দেখা হয়েছে শুধু কোর্টে। কথাবার্তা প্রায় হয়ইনি। জেল সূত্রের খবর, সুদীপ্ত সংক্রান্ত আলোচনাকে দেবযানী বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেন না। যদিও সুদীপ্ত কারাবাস পর্বেও বিভিন্ন সময়ে দেবযানীকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে গিয়েছেন। কী রকম? এক জেল-কর্তা জানান, বন্দিদশার গোড়ায় ক’দিন দেবযানীকেও আলিপুর সেন্ট্রালে রাখা হয়েছিল। ওঁকে যাতে স্টিলের থালায় খেতে দেওয়া হয়, সে জন্য সুদীপ্ত হাতজোড় করে জেল-অফিসারদের বিস্তর কাকুতি-মিনতি করেছিলেন। আবেদন মঞ্জুরও হয়। উপরন্তু তখনকার ‘ফ্যাশনদুরস্ত’ দেবযানীনামী-দামি ব্র্যান্ডের প্রসাধনীতে নিজেকে সাজাতে অভ্যস্ত ছিলেন। জেলের ভিতরে ওই সবের অভাবে তিনি যাতে মুষড়ে না পড়েন, সে দিকেও তীক্ষ্ণ নজর ছিল সুদীপ্তর। তাঁরই অনুরোধে দেবযানীকে বাড়ি থেকে আনা দামি সাবান-সহ কিছু প্রসাধনী ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়।

সারদা-কর্ণধার ঘোর দুর্দিনেও ‘ছায়াসঙ্গিনী’কে আগলে রাখতে চেয়েছেন। কিন্তু জেল-কর্তাদের কথায়, ‘‘এখন সাদা চোখে দেখে মনে হচ্ছে, ওঁর ছায়াই দেবযানীর উপর থেকে সরে গিয়েছে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Debjani mukhopadhyay Saradha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE