ম্যানহোলের গভীরতা ১০ ফুটেরও বেশি। কিন্তু সাফাইকর্মীদের বলা হয়েছিল, মেরেকেটে ৬-৭ ফুট! ভিতরে যে বিষাক্ত গ্যাস থাকতে পারে, সে কথাও স্পষ্ট ভাবে জানানো হয়নি। ‘মিথ্যে’ কথা বলে, তথ্য গোপন করে ফরজেম শেখকে ম্যানহোলে নামতে বলেছিলেন ধৃত ঠিকাদার আলিমুদ্দিন শেখ। এমনটাই দাবি করলেন বানতলার চর্মনগরীর ম্যানহোলে নেমে মৃত ফরজেমের ছেলে জাহাঙ্গির শেখ।
রবিবার লেদার কমপ্লেক্সে নিকাশি নালার কাজ করছিলেন কয়েক জন শ্রমিক। সেই কাজ চলার সময় চারিদিক থেকে ট্যানারির দূষিত জল কাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল। সেই জল বন্ধ করতেই কোনও রকম সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়া মই বেয়ে ম্যানহোলের ভিতরে নেমেছিলেন মুর্শিদাবাদের লালগোলার বাসিন্দা ৬২ বছরের ফরজেম। পরে সেখান থেকেই তাঁর নিথর দেহ উদ্ধার হয়। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে ম্যানহোলে নেমে বেঘোরে প্রাণ গিয়েছে লালাগোলার হাসিবুর রহমান এবং উত্তর ২৪ পরগনার ন্যাজাটের বাসিন্দা সুমন সর্দারের। সেই ঘটনায় রবিবার রাতেই গ্রেফতার হয় ঠিকাদার আলিমুদ্দিনকে।
জাহাঙ্গিরের দাবি, তাঁর কাকা কলকাতায় দেহ আনতে গিয়ে জানতে পেরেছেন, ম্যানহোলে নামা নিয়ে অনেক কথা ফরজেমের কাছে গোপন করেছিলেন ঠিকাদার। ম্যানহোল কতটা গভীর, সেই তথ্যই ঠিকমতো দেননি তিনি। জাহাঙ্গিরের কথায়, ‘‘আমরা জানতে পেরেছি, ম্যানহোলের গভীরতা ১০ ফুটের বেশি। কিন্তু আলিমুদ্দিন জানিয়েছিল, ৬-৭ ফুট হবে। ম্যানহোলের গভীরতা ৭ ফুট ধরেই নীচে নেমেছিলেন বাবা। কারণ, বাবার উচ্চতাই ৬ ফুটের কাছাকাছি। সুমন এবং হাসিবুর উপরে ছিলেন বালতি টেনে তোলার জন্য। কিন্তু বাবা নেমেই বুঝতে পারে, গভীরতা অনেকটাই বেশি। নীচে পাঁক জমে। এমন ভাবে আটকে গিয়েছিলেন যে, আর বেরোতে পারছিলেন না।’’
ছেলের অভিযোগ, ফরজেম ম্যানহোলে আটকে পড়ার পরেই আলিমুদ্দিনকে ফোন করেছিলেন সুমন এবং হাসিবুর। তখন আলিমুদ্দিনই দু’জনকে ম্যানহোলে নামতে বলেছিলেন। সেই মতো তাঁরাও নেমেছিলেন। কিন্তু তাঁদেরও একই পরিণতি হয়। তখনও উপরে দু’জন সাফাইকর্মী ছিলেন। তাঁরা আবার আলিমুদ্দিনকে ফোন করেছিলেন। কিন্তু তত ক্ষণে তাঁর ফোন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
আলিমুদ্দিন নিজেও মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা। এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, কাজের খোঁজে কয়েক বছর আগে কেরলে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে নির্মাণশ্রমিকের কাজ করতেন। এর পর রাজ্যে ফিরে এসে ঠিকাদারির কাজ শুরু করেন। পরিচয় হয় কলকাতার এক ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। তাঁর সূত্রে দমদম, বেলঘরিয়া এবং কলকাতার কয়েকটি জায়গায় নিকাশি নালা তৈরির কাজে শ্রমিক সরবরাহের বরাতও পেয়েছিলেন। এর পর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি আলিমুদ্দিনকে। শ্রমিকদের কেউ কেউ জানান, কলকাতায় কাজ পেতে আলিমুদ্দিনই তাঁদের একমাত্র ভরসা। যে কোনও সময় ফোন করলেই কাজের ব্যবস্থা করে দিতেন। কখনও কখনও শ্রমিকদের আগাম মজুরি দিয়ে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন।
আলিমুদ্দিনের কথাতেই বানতলায় কাজে আসা এক শ্রমিক জানান, ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ১৮ জন শ্রমিককে নিকাশি নালা তৈরির কাজে কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন আলিমুদ্দিন। সেই দলেই ছিলেন ফরজেম, হাসিবুর এবং সুমন। অভিযোগ, নিকাশি নালার কাজে নামার আগে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন সুরক্ষা আধিকারিক। শ্রমিকদের কাছে অক্সিজেন সিলিন্ডার, সেফটি বেল্ট, বিশেষ জ্যাকেট, স্পেশ্যাল মাস্কের মতো সুরক্ষা সরঞ্জাম রয়েছে কি না, তা তিনি জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শ্রমিকদের কাছে সে সব কিছু না থাকা সত্ত্বেও সকলে ‘হ্যাঁ’ বলেছিলেন। কারণ, তা-ই বলতে বলেছিলেন আলিমুদ্দিন। কাজ হারানোর ভয়ে সকলে ‘মিথ্যা’ বলেছিলেন বলে দাবি করেছেন ওই শ্রমিক।
মৃত হাসিবুরের দাদা করিম শেখও বলেন, ‘‘টাকা যতই বেশি হোক, ভিতরে নামার এত ঝুঁকি জানলে ভাই কখনওই নামত না। আমরা যেটুকু জানতে পেরেছি, ওদেরকে ম্যানহোলের গভীরতা ও বিষাক্ত গ্যাস সম্পর্কে কিছুই জানানো হয়নি। এটা কখনওই দুর্ঘটনা নয়।’’