রেলের ভাঁড়ে মা ভবানী দশা চলছে বছর কয়েক ধরে। হরেক কিসিমের কৌশল সত্ত্বেও লাভের মুখ দেখা যাচ্ছে না। ট্যাঁকের হাল যদি এতটাই সঙ্গিন, বুলেট বা ম্যাগনেটিক ল্যাভিটেশন ট্রেনের বিলাসিতা কেন— প্রশ্ন উঠছে রেলের অন্দরে।
একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে, বাড়তি গতি চাইলে চালু ট্রেনগুলিতেই তো তার পরীক্ষানিরীক্ষা করা যেতে পারে। আর পরিষেবা উন্নত করার সদিচ্ছা থাকলে সেটাও প্রমাণ করা যায় এখনকার বিভিন্ন ট্রেনে। সেই চেষ্টা না-করে রেলের লুজবুজে আর্থিক স্বাস্থ্যকে আরও দুর্বল করার এই পড়ি-মরি প্রয়াস কেন?
প্রশ্নগুলো যে রেলের অন্দরেও জোরদার হচ্ছে, হাজার চেষ্টাতেও আয় বাড়াতে না-পারাটাই তার কারণ। এ বছরের রেল বাজেটে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দিয়েছিলেন মন্ত্রী সুরেশ প্রভু। কিন্তু এপ্রিল থেকে জুলাই— আর্থিক বছরের প্রথম চার মাসের হিসেব বলছে, সেই লক্ষ্য পূরণ করা তো দূরের কথা, তার ধারেকাছেই পৌঁছতে পারেনি রেল।
রেলকর্তাদের একাংশ বলছেন, সপ্তম বেতন কমিশনের পরে কর্মীদের বেতন এবং অবসরপ্রাপ্তদের পেনশন বাবদ খরচের বোঝা বেড়েছে। তার উপরে অতি দ্রুত গতির বুলেট ট্রেন এবং ম্যাগনেটিক ল্যাভিটেশন ট্রেন চালানোর জন্য তড়িঘড়ি দরপত্র ডেকেছে রেল মন্ত্রক। কিন্তু এই প্রকল্প রূপায়ণের জন্য টাকার জোগান কোথা থেকে আসবে, সেই প্রশ্নের সুরাহা হয়নি। সেটাই চিন্তা বাড়াচ্ছে।
রেলের আয়ের হাল ঠিক কেমন?
রেল সূত্রের খবর, চলতি আর্থিক বছরের প্রথম চার মাসে অর্থাৎ এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত রেলের রোজগার হয়েছে ৫২ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা। অথচ এই সময়ের আর্থিক লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৯ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা। কিন্তু সেই লক্ষ্যমাত্রার থেকে সাত হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা কম আয় হয়েছে। গত ২০১৫-’১৬ অর্থবর্ষে একই সময়ে আয় ছিল ৫৫ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ আয় বাড়া দূরের কথা, গত বছরের ওই সময়ের তুলনাতেও তা কমেছে তিন হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা! বুলেট ট্রেন বা ল্যাভিটেশন ট্রেন এনে রেল যখন দ্রুততর হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখছে, তখন তাদের আয়ের এ-রকম শোচনীয় পশ্চাৎ-গতি কেন?
রেলকর্তাদের একাংশ বলছেন, তাঁদের মূল রোজগার পণ্য পরিবহণ থেকে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে পণ্য পরিবহণ কমে গিয়েছে। ফলে টান পড়েছে রোজগারেও। কিন্তু কর্মীদের বেতন এবং অবসরপ্রাপ্তদের পেনশন বাবদ দায় বেড়েই চলেছে। তার উপরে আছে যাত্রী পরিবহণের ভর্তুকি। সব মিলিয়েই আয়ের এই দুর্দশা।
পরিস্থিতি এতটা খারাপ বলেই বুলেট ও ম্যাগনেটিক ট্রেন চালানোর উচ্চাশী উদ্যোগ সমর্থন করতে পারছেন না রেলকর্তাদের বড় একটি অংশ। রেলের খবর, ম্যাগনেটিক ট্রেনের জন্য বিদেশি সংস্থাগুলিকে আগ্রহপত্র পেশ করতে বলা হয়েছে। কয়েকটি সংস্থা ইতিমধ্যেই আগ্রহ দেখিয়েছে। নতুন ধরনের এই হাইস্পিড ট্রেন এখন বাণিজ্যিক ভাবে চালানো হচ্ছে চিনে। সারা দেশে না-হোক, ভারতীয় রেল আপাতত ১৫ কিলোমিটার লাইনে পরিকাঠামো তৈরি করে পরীক্ষামূলক ভাবে ওই ট্রেন চালিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে চায়।
রেলের ভাঁড়ারের দুর্দশায় যে-সব কর্তা চিন্তিত, তাঁদের প্রশ্ন, আয় বুঝেই তো ব্যয় করা উচিত। আয় লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছচ্ছে না জেনেও এমন উচ্চাভিলাষ কেন? অভিলাষ কতটা উঁচু? রেল সূত্র জানাচ্ছে, বুলেট ট্রেনের লাইন পাততে প্রতি কিলোমিটারে খরচ প্রায় ১৭০ কোটি টাকা। আর ম্যাগনেটিক ট্রেনের লাইন পাততে কিলোমিটার-পিছু খরচ ১৮০ থেকে ১৯০ কোটি টাকা।
কিছু রেলকর্তার প্রশ্ন, ভাঁড়ারের মা ভবানী দশায় এত বিপুল খরচের রাস্তায় হাঁটার যুক্তি কী? রেলকর্তাদের কেউ কেউ বলছেন, জবাবে যাত্রী-কল্যাণের কথা তুললে সেটা খুব যুক্তিগ্রাহ্য হওয়ার কথা নয়। কারণ, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সময়মতো ট্রেন চললেই যাত্রীরা সব চেয়ে বেশি উপকৃত হবেন। তাই সেটাকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত। পরিকাঠামোর উন্নতি ঘটিয়ে দূরপাল্লার ট্রেনগুলির গড় গতিবেগ বাড়ানোর চেষ্টা করা দরকার।
‘‘রেলের উন্নতি আমরা সকলেই চাই। ট্রেনের গতি বাড়ুক, চাই সেটাও। কিন্তু সব কিছুর আগে তো ভাঁড়ারের অবস্থাটা ভাল করে যাচাই করে নেওয়া দরকার,’’ বলছেন প্রাক্তন রেলকর্তা সুভাষরঞ্জন ঠাকুর। তিনি মনে করেন, দেশে যে-ক’টি দ্রুত গতির ট্রেন চলে, সেগুলির গড় গতি বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে পারলে গতির স্বপ্ন অনেকটাই পূরণ হতো।
যাবতীয় প্রশ্ন আর সমালোচনার জবাবে রেল মন্ত্রকের বক্তব্য, অতি দ্রুত গতির ট্রেন চালানোর সব প্রকল্পই রূপায়িত হবে ‘প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ’ অর্থাৎ যৌথ উদ্যোগে। সেই খরচের সামান্য একটি অংশ দিতে হবে রেলকে। বাকি টাকা জোগাবে রেলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা বেসরকারি সংস্থা। তাই ওই প্রকল্পের জন্য রেলের ভাঁড়ারে তেমন কোনও বাড়তি টান পড়ার আশঙ্কা নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy