Advertisement
১৯ মে ২০২৪

হাটে-বাজারে হয়রানির অন্ত নেই, তবু ‘খুশ’ পাবলিক

কারও দোকানে বিক্রি অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। সারা দিন ব্যাঙ্কে লাইন দিয়ে কেউ পেয়েছেন শুধু দু’হাজারি নোট। হাতে নিয়ে ঘুরছেন, ভাঙাতে পারছেন না। কেউ জানেন না মাঠে পড়ে থাকা ধান কী ভাবে কাটাবেন, কোথা থেকে আসবে আলু চাষের টাকা।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৬ ০২:৪৮
Share: Save:

কারও দোকানে বিক্রি অর্ধেক হয়ে গিয়েছে।

সারা দিন ব্যাঙ্কে লাইন দিয়ে কেউ পেয়েছেন শুধু দু’হাজারি নোট। হাতে নিয়ে ঘুরছেন, ভাঙাতে পারছেন না।

কেউ জানেন না মাঠে পড়ে থাকা ধান কী ভাবে কাটাবেন, কোথা থেকে আসবে আলু চাষের টাকা। তবু এ নিয়ে কথা উঠলে অনেকেই জোরে-জোরে মাথা নেড়ে বলছেন— ‘‘ঠিক হয়েছে।’’ সেলুনে, মাছবাজারে, পাড়ার মোড়ে এমন মাথা অগুনতি।

সন্দেহ নেই, অসংগঠিত ক্ষেত্রের মজুরেরা মার খাচ্ছেন। মার খাচ্ছেন ছোট ব্যবসায়ীরাও। তামাদি পাঁচশো-হাজারের নোটে ঠিকা ও চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের বেতন দিচ্ছেন মালিকেরা। হাওড়া শিবপুরে লেদ কারখানা থেকে মুর্শিদাবাদের বিড়ি শ্রমিক— একই দশা। তবু এই মার খাওয়া জনতারই একাংশ হাততালি দিচ্ছে।

মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টা। নদিয়ার বেথুয়াডহরি স্টেশনে ডাউন প্ল্যাটফর্মে দু’হাজার টাকার নোট স্মার্টফোনের সামনে ধরে অ্যাপে নরেন্দ্র মোদীর বক্তব্য শুনছিলেন জনা পাঁচ-ছয়। এঁরা কেউ ছোট ব্যবসায়ী, কেউ চাষি, কেউ ফেরিওয়ালা। শুনতে-শুনতেই লোকাল ট্রেনের এক বাদাম বিক্রেতা বলে ওঠেন, ‘‘আমার তো বিক্রিবাটা অর্ধেকেরও কম। কিন্তু যা-ই বলিস ভাই, লোকটার দম আছে।’’ পাশ থেকে মুচকি হাসেন এক বেসরকারি সংস্থার কর্মী— ‘‘আমাদের এলাকায় তো এক নেতা পাটের জমিতে টাকা পুঁতে রেখেছিল। দেখ কেমন লাগে!’’

হয়রানির রুটিন অবশ্য এ দিনও জারি ছিল। কোচবিহারে ভেটাগুড়ি গ্রামীণ ব্যাঙ্কের ম্যানেজারকে বাইরে বসিয়ে রাখেন ক্ষুব্ধ গ্রাহকেরা। দক্ষিণ দিনাজপুরের হরিরামপুর ডাকঘর ও জলপাইগুড়ির ধূপগুড়িতে প্রধান ডাকঘরেও গ্রাহক বিক্ষোভে কাজ বন্ধ থাকে। টাকা হাতে পেলেও কিন্তু স্বস্তি নেই। পুরুলিয়ার আড়শায় সিরিডি গ্রামের হাবুলাল মাহাতো প্রায় কেঁদেই ফেলেন— ‘‘দিনভর লাইন দেওয়ার পরে ব্যাঙ্ক ২০০০ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়েছে। ভাঙাবে কে?’’ কিন্তু তা বলে তিনি সরকারকে দায়ী করছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘কষ্ট হচ্ছে। তবু কালো টাকা ধরতে সরকার ভাল কাজ করেছে।’’

বহু মাঠে এখনও ধান পড়ে আছে। ঘরে পড়ে আছে পাট, যা বিক্রি করে রবিশস্য চাষের খরচ ওঠে। দিন পনেরো আগেও পাটের দাম ছিল কুইন্টাল প্রতি পাঁচ হাজার টাকা। গত দু’সপ্তাহে তিন হাজারে নেমেছে। পড়ে গিয়েছে পঞ্জাবের আলুবীজের দামও। হুগলির আরামবাগে প্রৌঢ় আলুচাষি অজয় রায় বলেন, ‘‘২৪০০ টাকা প্যাকেট থেকে ১৬০০ টাকায় নেমেছে বীজের দাম। টাকা কোথায়?’’ পরের মুহূর্তেই তাঁর উপলব্ধি— ‘‘কিন্তু দাম তো কমেছে!’’

বর্ধমানের কালনায় রাহাতপুর গ্রামে পেঁয়াজ চাষ গত বারের তুলনায় কিছুই এগোয়নি। সোমবার আত্মঘাতী হন ভাগচাষি শিবপদ মান্ডি। সমবায় ব্যাঙ্কে গচ্ছিত টাকা আটকে যাওয়ায় তিনি খেতমজুরদের পাওনা মেটাতে পারছিলেন না। স্থানীয় একচাকা কৃষি উন্নয়ন সমিতির সম্পাদক ইয়াসিন শেখ জানান, চাষিরা প্রাপ্য টাকা চাইলেও তাঁরা দিতে পারছেন না। মহাজনদের কাছে হাত পেতেও লাভ হচ্ছে না। কারণ, তাঁদের ভাঁড়ারেও নগদ বাড়ন্ত।

সরকারি হিসেবে, এ রাজ্যের ৩৪ হাজারেরও বেশি গ্রামে কোনও ব্যাঙ্ক নেই। শিলিগুড়ির কাছে বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া নিজবাড়ি তেমনই একটি গ্রাম। নগদের অভাবে বেশির ভাগ গ্রামবাসী স্রেফ আলু-মুলো সিদ্ধ খেয়ে কাটাচ্ছেন। কিন্তু তার পরেও যে তেমন ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে না, তার বড় কারণ সম্ভবত মুষ্টিমেয় কিছু লোকের ফুলে-ফেঁপে ওঠা নিয়ে জনতার পোষা রাগ। দক্ষিণ দিনাজপুরে তপনের বালাপুরে চায়ের আড্ডায় এক নেতার নাম করে এক চাষি তো বলেই ফেললেন, ‘‘ওদের ঘর থেকে পিছনের পুকুরে যাওয়ার রাস্তা মোজাইক করা। মোটা সোনার চেন। দামী গাড়ি। অথচ পাঁচ বছর আগেও কী অবস্থা ছিল!’’

এক কাঠখড় পুড়িয়ে কত কালো টাকা সত্যি ধরা পড়বে বা নিদেনপক্ষে নষ্ট হবে, তা নিয়ে সন্দেহ করার লোক যে উবে গিয়েছে, তা কিন্তু নয়। এ দিন সাতসকালে লালগড়ের বৈতা-যশপুর বাজারে নীলুদার চায়ের দোকানে ঠাসাঠাসি ভিড়। চায়ের গ্লাসটা টেবিলে ঠক করে নামিয়ে বালিশিরার দুলাল চালক বলে ওঠেন, “ব্যাঙ্ক-ডাকঘরের লাইনে কই বড়লোকদের তো দেখছি না। ওরা কী কায়দায় কালো টাকা সাদা করে ফেলছে, কে জানে!” কিন্তু তাঁকে প্রায় থামিয়ে রোহিনীর রমেশ বেরা বলেন, “আরে, ওরা বাথরুমে, ঠাকুরঘরে কোটি কোটি টাকা লুকিয়ে রেখেছে বলেই জিনিসপত্রের দাম এত বেড়েছে। এ বার ঘুঘু ফাঁদে পড়েছে!’’

হাওড়ার বালি ঘোষপাড়ায় সেলুনে ঢুকেছিলেন টোটোচালক বিশু দাস। মুচকি হেসে তাঁর টিপ্পনী— ‘‘কেসটা আসলে কী বলুন তো দাদা? ফিল্মে বচ্চন গব্বরকে হেব্বি ঝাড়ছে। দেখেই আমাদের মতো পাবলিক খুশ! কিছু না হোক, গায়ের ঝাল তো মিটছে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

demonetisation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE