Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

দারিদ্র স্পর্শ করতে পারেনি অরিন্দম, পূজাকে

উচ্চমাধ্যমিকে ৩৯৮ পেয়ে মার্কশিট নিয়ে ছেলে যখন বাবাকে খুঁজতে সাইকেল নিয়ে ছুট লাগাল, বাবা তখন পাড়ায় পাড়ায় লোহা ভাঙা, কাচ ভাঙা নিয়ে হাঁক দিতে দিতে যাচ্ছেন। চার কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে এসে বাণীবন যদুরবেড়িয়া বিদ্যাপীঠের ছাত্র অরিন্দম মিস্ত্রী দেখল, বাবা রয়েছেন বাড়ির কাছেই। অন্য দিনের থেকে একটু তাড়াতাড়িই ফিরে এসেছেন ছেলের রেজাল্ট দেখবেন বলে।

বাবার সঙ্গে অরিন্দম।

বাবার সঙ্গে অরিন্দম।

নিজস্ব সংবাদদাতা
উলুবেড়িয়া শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৪ ০১:৩৫
Share: Save:

উচ্চমাধ্যমিকে ৩৯৮ পেয়ে মার্কশিট নিয়ে ছেলে যখন বাবাকে খুঁজতে সাইকেল নিয়ে ছুট লাগাল, বাবা তখন পাড়ায় পাড়ায় লোহা ভাঙা, কাচ ভাঙা নিয়ে হাঁক দিতে দিতে যাচ্ছেন। চার কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে এসে বাণীবন যদুরবেড়িয়া বিদ্যাপীঠের ছাত্র অরিন্দম মিস্ত্রী দেখল, বাবা রয়েছেন বাড়ির কাছেই। অন্য দিনের থেকে একটু তাড়াতাড়িই ফিরে এসেছেন ছেলের রেজাল্ট দেখবেন বলে।

থেকে দু’টি বিষয়ে লেটার নিয়ে উচ্চমাধ্যমিকে ৩৯৮ পেয়েছে বাণীবন গোয়ালবেড়িয়া গ্রামের অরিন্দম। বাংলায় ৭৫, ইংরেজিতে ৭৫, রসায়নে ৭৮, অঙ্কে ৮৭ আর পদার্থবিদ্যায় ৮৩ পেয়েছে সে। ছেলেকে দেখেই জড়িয়ে ধরলেন বাবা। তবে এর পরে অরিন্দমের উচ্চ শিক্ষার কী হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে এই পরিবারের। অরিন্দমের ইচ্ছা অঙ্ক নিয়ে পড়ার। তার পরে কলেজে শিক্ষকতা করার ইচ্ছে তার।

এক ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে সংসার অরিন্দমের বাবা তীর্থ মিস্ত্রীর। প্রতি দিন সকালে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে পাড়ায় পাড়ায় লোহাভাঙা, কাচ ভাঙা কিনতে। দিনের শেষে পাড়া থেকে ওই সব ভাঙা জিনিস নিয়ে ফোড়েকে দিয়ে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা রোজগার হয়। ওই টাকার মধ্যেই কোনও রকমে সংসার চালাতে হয় তাঁকে। এর মধ্যে লেখাপড়া করা তার কাছে বিলাসিতা। তবু ইচ্ছা তো কোনও বাধা মানে না। এর পরে অঙ্ক নিয়ে পড়ার ইচ্ছে তার। তার পরে কলেজে শিক্ষকতার স্বপ্ন রয়েছে তার। অরিন্দমের মা চম্পা মিস্ত্রী বলেন, “অনেক কষ্ট করে ছেলেকে পড়াচ্ছি। ছেলেমেয়েদের ঠিক মতো যত্নআত্তি করতে পারিনি। ছেলের প্রয়োজন মতো খাতা বই কিনে দিতে পারিনি। তাই ঘরের মেঝেতে অঙ্ক করত ছেলে।” ১০ ফুট বাই ১২ ফুটের ইটের ঘরে বাঁশের দরমা দিয়ে কোনও রকমে দরজা জানলা করা হয়েছে। টিনের চালের সেই ঘরেই চার জনের সংসার। তবু দারিদ্র স্পর্শ করতে পারেনি অরিন্দমকে। পাড়ার শিক্ষক শক্তি প্রামাণিকের কাছে ছোট থেকে পড়াশোনা করেছে সে। তিনি বলেন, “ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভাল অরিন্দম। ওকে পড়াতে আমার ভাল লাগত। ওদের সংসারের কথা ভেবে টাকা নিইনি কখনও।” এছাড়াও প্রায় বিনা বেতনে অরিন্দমকে পড়াতেন তিন জন শিক্ষক।

জরির কাজে ব্যস্ত পূজা।

অরিন্দম জানায়, পড়াশোনার জন্য তার কোনও রুটিন ছিল না। যখন যা ভাল লাগত, যখন যা ইচ্ছে করত তখন তাই পড়ত। তবে দিনে নিয়ম করে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা পড়াশোনা করত সে। অবসর সময়ে ক্রিকেট খেলা ও গান শুনত সে। অঙ্ক নিয়ে পড়ার ইচ্ছা থাকলেও জয়েন্টও দিতে চেয়েছিল অরিন্দম। কিন্তু অর্থাভাবে এ বার জয়েন্ট দিয়ে ওঠা হয়নি তার। অরিন্দমের কথায়, “যদি কোনও সহৃদয় ব্যক্তি আমাকে সাহায্য করেন, তবে আমি হয়তো আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারব।”

উলুবেড়িয়ার জগৎপুরের পূজাও ছোট থেকেই লড়াই করছে অভাবের সঙ্গে। যে বয়সে সবাই পড়াশোনা, খেলাধুলো করে, সেই বয়সে তাকে জরির কাজ করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে হয়েছে। জগৎপুর আদর্শ বিদ্যালয় থেকে একটি লেটার নিয়ে ৩৬৭ নম্বর পেয়েছে সে। বাংলায় ৭০, ইংরেজিতে ৭২, এডুকেশনে ৭৬, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ৬৮, ভূগোলে ৮১ পেয়েছে সে। গৃহশিক্ষকও তেমন ছিল না তার। পূজার বাবা অমর আদক বলেন, “ওর পড়াশোনার খরচ আমি তো একা জোগাড় করতে পারিনি। তাই ও নিজেই কাজ করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালিয়েছে।” পূজা মাধ্যমিক পাশ করেছিল ৬টি লেটার নিয়ে। কিন্তু অর্থাভাবে তার পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন অমর আদক। তিনি বলেন, “স্কুলে যাওয়ার জন্য বাড়িতে কেবল কান্নাকাটি করত। কিন্তু অভাব পিছু ছাড়েনি।”

এক দিন কাঁদতে কাঁদতে জ্যেঠু বিনোদবাবুকে বিষয়টি জানায় পূজা। তিনিই তাঁকে স্কুলে নিয়ে গিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে স্কুলে ভর্তি করে দেন। তত দিনে অবশ্য এক বছর কেটে গিয়েছে। মনের জোর দমাতে পারেনি পূজাকে। নতুন করে পড়া শুরু করল পূজাা। স্কুলের শিক্ষক ও পাড়ার কোচিং সেন্টারের শিক্ষকেরা বিনা বেতনেই পড়াতেন তাকে। উচ্চ মাধ্যমিকের পরে ভূগোল নিয়ে পড়ার ইচ্ছা তার। বড় হয়ে শিক্ষিকা হতে চায়। কিন্তু কলেজে ভর্তি হতে গেলে যে টাকা লাগবে, তা জোগাড় হবে কী করে, তা নিয়ে চিন্তিত তার পরিবারের লোকজন। তবে দমছে না পূজা। তার জেদ, বাবার সঙ্গে কাজ করেই পড়াশোনা চালাবে সে। এত দিনে বাবাও বুঝে গিয়েছেন, নিজের জেদ পূরণ করেই ছাড়বে মেয়ে। বললেন, “আমার যত কষ্টই হোক, প্রয়োজনে অন্যের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে পড়াব ওকে।”

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE