Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
জল, আলো নেই, দিন কাটে বাঘের আতঙ্কে

দিল্লি পাঠালে সমাধান, আশ্বাস প্রার্থীর

‘রাতে মাঝেমধ্যে বাঘের ডাকে ঘুম ভেঙে যায়। খুব ভয় করে। মাকে জাপ্টে ধরি’। গড় গড় করে কথাগুলো বলে যায় সুন্দরবনের জঙ্গল লাগোয়া সামসেরনগরের কুড়েখালি খালের পাশে শকুনখালি গ্রামের সেরিনা খাতুন, মধুমন্তী মণ্ডল। তাদের ঘিরে আরও কিছু ছেলেমেয়ে। দু’জনেই স্কুলে পড়ে। কদিন ধরেই ওরা শুনছিল এলাকায় কোনও একজন আসবেন তাদের কথা শুনতে। বড় কেউ।

জঙ্গলের ধারে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলছেন ইদ্রিস আলি।—নিজস্ব চিত্র।

জঙ্গলের ধারে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলছেন ইদ্রিস আলি।—নিজস্ব চিত্র।

নির্মল বসু
হিঙ্গলগঞ্জ শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৪ ০০:৫৭
Share: Save:

‘রাতে মাঝেমধ্যে বাঘের ডাকে ঘুম ভেঙে যায়। খুব ভয় করে। মাকে জাপ্টে ধরি’। গড় গড় করে কথাগুলো বলে যায় সুন্দরবনের জঙ্গল লাগোয়া সামসেরনগরের কুড়েখালি খালের পাশে শকুনখালি গ্রামের সেরিনা খাতুন, মধুমন্তী মণ্ডল। তাদের ঘিরে আরও কিছু ছেলেমেয়ে। দু’জনেই স্কুলে পড়ে। কদিন ধরেই ওরা শুনছিল এলাকায় কোনও একজন আসবেন তাদের কথা শুনতে। বড় কেউ। এ দিন ওই এলাকায় প্রচারে যাওয়া বসিরহাটের তৃণমূল প্রার্থীকে সামনে পেয়ে কথাগুলো উগরে দেয় সেরিনা, মধুমন্তী। প্রার্থী মন দিয়ে যখন তাদের কথা শুনছেন, তখন ভেসে এল আরও কিছু কচি কণ্ঠ, “মাস্টারের কাছে পড়ে সন্ধের পর অন্ধকার রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় ভয় করে। কখন বাঘে ধরে। রাস্তায় একটা আলো লাগিয়ে দেবে কাকু।” সমস্যা শুনে তা সমাধানের আশ্বাস দেওয়ার আগেই ফের আবেদন, “দাদা আমাদের এখানে পানীয় জলের রং সরষের তেলের মতো। যানবাহনের অবস্থা বেশ খারাপ। এগুলোর একটা ব্যবস্থা করুন।” নিজের কেন্দ্রের মধ্যে হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকে সোমবার দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে প্রচারে গিয়েছিলেন বসিরহাটের তৃণমূল প্রাথর্ীর্ ইদ্রিস আলি। উদ্দেশ্য ছিল সুন্দরবন লাগোয়া গ্রামগুলির মানুষের প্রকৃত অবস্থা সরেজমিন দেখা, তাঁদের সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া। গ্রামের বড়রা তো বটেই ছোট ছোট মুখগুলোতেও সমস্যার কথা শুনে কিছুটা হতবাকই হয়ে পড়লেন প্রার্থী। ভেসে এল স্বগতোক্তি, “সত্যিই এদের বড় দুর্দশা।”

তবে সেখান ছেড়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে যেতেই অবশ্য স্বস্তি পেলেন। প্রার্থীকে ঘিরে ধরা জনতার মধ্যে থেকে ভেসে এল মহিলা কণ্ঠস্বর। দুই গৃহবধূ অনিমা মণ্ডল, সুষমা মিস্ত্রী জানালেন, “রাজ্যে সরকার বদলের পরে রাস্তা হয়েছে। বাঘ আটকাতে জঙ্গলের ধারে জাল লাগানো হয়েছে। চাল পাচ্ছি ২ টাকা দরে। তবে রাস্তায় বিদ্যুতের খুঁটি বসলেও আলো জ্বলে না। খাবার জলও খুব খারাপ। এই এলাকায় আর্সেনিক রয়েছে। ভাল জল পেতে ৫-৭ কিলোমিটার হাঁটতে হয়। চিকিৎসা পরিষেবা বলতে প্রায় কিছুই নেই।” এর পরেই প্রার্থীকে প্রশ্ন, “আপনি দিল্লি গেলে আমাদের কথা বলবেন তো?”

রাস্তার ধারে চপ, জিলিপির দোকান নিমাই মণ্ডলের। প্রার্থী আপনাদের এলাকায় এসেছেন প্রচারে। আপনাদের সমস্যার কথা শুনতে। ওঁর কাছে কী চাইবেন?” প্রশ্ন শুনেও নিরুত্তাপ নিমাইবাবু। ফের প্রশ্ন করায় মুখ খুললেন, “এই সামান্য দোকানের আয়ে সংসার চলে না। তাই মাছ, কাঁকড়া ধরতে মাঝেমধ্যেই জঙ্গলে যাই। বাঘের মুখেও পড়েছি। আমার বাবাকে বাঘে খেয়েছে। কিন্তু আমাদের দুঃখ শোনার কে আছে বলুন।? ভোট এলে এলাকায় অনেক নেতারই পা পড়ে। সবাই সমস্যা মিটিয়ে দেওয়ার কথা বলে চলে যান। ভোটে জিতে ফের আসার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু জেতার পর ভো-কাট্টা।” কথাটা তৃণমূল প্রার্থী কানে যেতেই কয়েকজনকে সরিয়ে এগিয়ে এলেন। তারপর বক্তার উদ্দেশে বললেন, “নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আমার ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো তাঁর সৈনিকেরাও কথার দাম রাখেন। দিল্লি পাঠালে আপনাদের সমস্যার সমাধান আদায় করেই গ্রামে ফিরব।” কথা শেষ করে দোকানের মধ্যেই বসে পড়েন তৃণমূল প্রার্থী। এগিয়ে আসে জিলিপি ভর্তি ঠোঙা। হঠাৎই তাঁর দিকে এগিয়ে আসে এক বালক। “তুমি বাঘ দেখেছ?” ছোট্ট প্রশ্নকর্তাকে পাল্টা প্রশ্ন প্রার্থীর, “তোমার নাম কী?” উত্তর, “আশাদুল গাজি”। তুমি দেখেছ?” উত্তর, “না, তবে শেয়াল, বাঁদর, হরিণ দেখেছি। বাবা বলেছে আমাদের জমি নেই, তাই জঙ্গলের পাশে খালের ধারে থাকি। রাতে বাঘের ডাকে খুব ভয় করে। গাঁয়ের ভিতরে আমাদের একটা ঘর করে দাও না।” আশাদুলের গাল টিপে প্রার্থীর আশ্বাস, “জিতলে তোর ইচ্ছা পূরণ করবই।”

দোকান থেকে বেরিয়ে কর্মীদের নিয়ে হাঁটা লাগালেন ইদ্রিস আলি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE