Advertisement
E-Paper

বাপ্পির সভায় ভিড় দেখে ঠিক থাকছে না মেজাজ

সকাল ৭টা। গঙ্গাপারের শহর উত্তরপাড়ায় এই সময় রোদ কিছুটা নরম। জিটি রোড ধরে একের পর এক ছুটে যাচ্ছে ঝান্ডা লাগানো গাড়ি। চলেছে উত্তরপাড়া কলেজ লাগোয়া ‘দাদার’ আবাসন চত্বরে। সেখান থেকেই শুরু হবে মনোনয়ন জমা দেওয়ার মারকাটারি র‌্যালি। যাবে চুঁচুড়া। ধর্মপ্রাণ দাদা, তৃণমূলের বর্তমান সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ভোরে উঠেই দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিয়ে এসেছেন। তার পর হুডখোলা গাড়িতে সওয়ার হয়ে চললেন জেলাশাসকের দফতরে।

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৪ ০৪:০১

সকাল ৭টা। গঙ্গাপারের শহর উত্তরপাড়ায় এই সময় রোদ কিছুটা নরম। জিটি রোড ধরে একের পর এক ছুটে যাচ্ছে ঝান্ডা লাগানো গাড়ি। চলেছে উত্তরপাড়া কলেজ লাগোয়া ‘দাদার’ আবাসন চত্বরে। সেখান থেকেই শুরু হবে মনোনয়ন জমা দেওয়ার মারকাটারি র‌্যালি।

যাবে চুঁচুড়া।

ধর্মপ্রাণ দাদা, তৃণমূলের বর্তমান সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ভোরে উঠেই দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিয়ে এসেছেন। তার পর হুডখোলা গাড়িতে সওয়ার হয়ে চললেন জেলাশাসকের দফতরে। সঙ্গে অগুনতি গাড়ির মিছিল। তার আগা যখন কোন্নগর ছুঁল, শেষ মাথা তখনও দু’কিলোমিটার দূরের ভদ্রকালী সখেরবাজারে চলমান। মিছিল-পথের দু’ধারে, রোয়াকে-বারান্দায় অজস্র জটলা। ভদ্রকালীর শিবতলায় ফুল উড়ে এল দাপুটে আইনজীবী প্রার্থীর গাড়ি লক্ষ্য করে। হাসিমুখে হাত নাড়লেন কল্যাণ। যা দেখে মোটরবাইকে সওয়ার সঙ্গী তরুণের মন্তব্য, “এই হাসিটাই যদি সব সময় থাকত, তা হলে স্রেফ কোনও কথা উঠতো না বস।”

গত লোকসভায় শ্রীরামপুর কেন্দ্রে ১ লক্ষ ৩৭ হাজার ভোটে জিতেছিলেন কল্যাণবাবু। বিধানসভা ভোটে আরও শক্ত হয়েছে তৃণমূলের মাটি। সাতটা বিধানসভাতেই জিতেছেন তৃণমূল প্রার্থী। লোকসভার ভোটে পিছিয়ে থাকা জাঙ্গিপাড়াতেও। পঞ্চায়েত ভোটেও এলাকার সাতটি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে ছয়টিই তৃণমূলের দখলে। তার পরেও কথা উঠছে কেন?

তৃণমূলের অন্দরে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে সাংসদের ‘বিখ্যাত’ মেজাজের কথা। রাখঢাক না-রাখা মুখের জেরে এই ক’বছরে বেশ খানিকটা অপ্রিয় হয়েছেন তিনি। মেজাজ হারানোর কথা মেনে নিচ্ছেন কল্যাণবাবু নিজেও। তাঁর কথায়, “এটা ঠিক যে কাজের ফাঁকে কোনও কোনও সময় খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি। তবে দলের প্রতিটি কর্মীকে ভালবাসি। তাই পরক্ষণেই আবার তাদের কাছে টেনে নিয়েছি। কিন্তু আমি যতটা না মেজাজ হারিয়েছি, তার থেকে প্রচার হয়েছে বেশি।”

প্রচারের জন্যই হোক বা অন্য কারণে, খানিকটা হলেও চিন্তায় তৃণমূল। সেই সঙ্গে বিজেপির গায়ক-প্রার্থী বাপ্পি লাহিড়ীর রোড শোয়ে ভিড় দেখে রক্তচাপ আরও বাড়ছে শাসক দলের অন্দরে!

উত্তরপাড়া অমরেন্দ্রনাথ বিদ্যাপীঠের সামনে দিয়ে দুলকি চালে চলেছে বাপ্পি লাহিড়ীর চার চাকা। এলইডি আলোয় উপচে পড়ছে তাঁর হাসি। বক্সে বাজছে গান। আর গাড়ির পাশে পাশে পড়িমরি করে ছুটছে আট থেকে আশির দল। কেউ এক বার ছুঁতে চায়, কেউ শুনতে চায় এক কলি গান। অটোগ্রাফের জন্য কাগজও আসছে একের পর এক। কাঁঠালবাগান বাজারের এক কাগজ বিক্রেতা হাতের কাছে কিছু না-পেয়ে পড়শি আলুওয়ালার হিসেবের খাতাই ছিনিয়ে নিয়ে বাড়িয়ে দিলেন সুরকারের দিকে। কাঁঠালবাগানের পাট চুকিয়ে গাড়ি যখন শান্তিনগরের পথে, রাত তখন আটটা। ভিড়ও ছুটল গাড়ির পিছু পিছু।

শ্রীরামপুরের প্রবীণ বাসিন্দাদের কেউ কেউ বলছেন, এই ভিড়ের প্রতিফলন যদি ভোটবাক্সে ঘটে, তা হলে এ বার তৃণমূলের কিঞ্চিৎ ব্যথা আছে। বাপ্পি লাহিড়ীর দাবি, “শ্রীরামপুরে মানুষের যে ভালবাসা পাচ্ছি, তাতে জয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত।” এতটা না বললেও, অনেকের মতে মূলত ঘাসফুলের ভোট কেটেই তাদের বেগ দিতে পারে পদ্মফুল। তৃণমূলের গত বারের হিসেব থেকে বাদ যাবে কংগ্রেসের ভোট। এ বার তারা আর জোটে নেই। এবং খোদ রাহুল গাঁধীর নির্দেশে লড়াইয়ের ময়দানে চাঁপদানির প্রাক্তন বিধায়ক আব্দুল মান্নান। গোড়ায় ভোটে নামতে গররাজি থাকলেও এই পোড়খাওয়া প্রবীণ নেতা কংগ্রেসের সাবেক ভোটব্যাঙ্কের কতটা দখলে রাখতে পারবেন, তার উপরেও অনেকটাই নির্ভর করবে শ্রীরামপুরের ভোট অঙ্ক। মান্নানের দাবি, “অভূতপূর্ব সাড়া পাচ্ছি। আমার রাজনৈতিক অতীতও আমাকে সাহায্য করছে।” এই অঙ্ক কষেই নাকি প্রচারে নেমেও মাঝেমধ্যেই মেজাজ হারাচ্ছেন কল্যাণবাবু। বিজেপি প্রার্থীর মুখোমুখি হয়ে টিপ্পনি কাটছেন, ‘বাপি বাড়ি যা’।

পাল্টা যুক্তিও রয়েছে। প্রথমত, বাপ্পি লাহিড়ীকে দেখতে যে পরিমাণ ভিড় হচ্ছে, তার কতটা ভোটবাক্সে আসবে, তা নিয়ে বিজেপি নেতাদের একাংশেরই সন্দেহ রয়েছে। কেননা, ভিড়কে ভোটে পরিণত করার জন্য যে সংগঠন দরকার, তা এখনও শ্রীরামপুরে দলের নেই। তা ছাড়া, “কে বলেছে বিজেপি শুধু তৃণমূলের ভোট কাটবে? সিপিএমের নয়। শ্রীরামপুর কলেজে আমার পরিচিত এক সময়ের এসএফআইয়ের এক কর্মীকে হইহই করে মাথায় ফেট্টি বেঁধে বিজেপির রোড-শোয়ে হাঁটতে দেখেছি।” বললেন কোন্নগরের এক প্রবীণ বাসিন্দা।

কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্ক প্রসঙ্গে পাল্টা যুক্তি, দেশে যখন কংগ্রেস-বিরোধী হাওয়া, তখন শ্রীরামপুর ব্যতিক্রম হবে, এমনটা মনে করার কারণ নেই। তার উপরে মান্নান যখন অনিচ্ছুক ঘোড়া। স্বাস্থ্যের কারণ দেখিয়ে লড়তেই চাননি তিনি। তার পর হুগলির দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করে সন্ন্যাস নেওয়ার কথা পর্যন্ত ঘোষণা করে ফেলেছিলেন। সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরেছেন বটে, কিন্তু তাঁর অপছন্দের প্রার্থীকে দল সরায়নি। প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে ফাটলও মেটেনি মান্নানের।

তৃণমূল অবশ্য ঝুঁকিই নিতে চাইছে না। যত দিন যাচ্ছে, প্রচারের লড়াই তীব্র করছে তারা। বিজেপির সুরকার প্রার্থী গান বেঁধেছেন। তৃণমূলও পেশাদার সংস্থাকে দিয়ে সুর বসিয়েছে দলনেত্রীর লেখা কবিতায়। মিটিং-মিছিলে বাজছে সেই সিডি। প্রচারের শেষ লগ্নে খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আনারও চেষ্টা চলছে।

প্রকাশ্যে যদিও তিনি তেমন কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে বলে মানতে নারাজ কল্যাণবাবু। বিজেপি প্রার্থী সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তাঁর হাল্কা টিপ্পনি, “মুম্বই সে আয়া মেরা দোস্ত। দোস্ত কো সেলাম করো।” তার পরেই জুড়ছেন, “যাঁরা আমার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, ব্যক্তিগত স্তরে তাঁদের কারও সম্বন্ধেই আমার কিছু বলার নেই। লড়াই তো নীতি নির্ধারণের।”

মুম্বই থেকে লড়তে এসে ‘শ্রীরামপুরকে ভালবেসে ফেলা’ বিজেপি প্রার্থীকে নিয়ে তৃণমূলের যতটা মাথাব্যথা, প্রধান প্রতিপক্ষ সিপিএম-কে নিয়ে ততটা নয়। ছাত্র রাজনীতির গণ্ডি ছাড়িয়ে জীবনে প্রথম বড় ভোটে লড়তে আসা তরুণ সিপিএম প্রার্থী তীর্থঙ্কর রায় ঘুরছেন চরকির মতো। এলাকার বাম নেতাদের দাবি, তীর্থঙ্করের ‘গুড বয় ইমেজ’ শুধু সংগঠনকেই চাঙ্গা করেনি, মানুষের মধ্যেও সাড়া জাগিয়েছে। বসে যাওয়া অনেক সিপিএম কর্মী-সমর্থকই এখন তাঁর মিটিং-মিছিলে সামিল। শ্রীরামপুরের বর্তমান সাংসদকে বিঁধে তীর্থঙ্কর বলছেন, “গ্রাম থেকে শহর রাস্তাঘাটের অবস্থা বেহাল। দিনের পর দিন জিটি রোড সারানো হয় না। ভোটে জিতে এ দিকে নজর দেব।”

প্রার্থী বলছেন বটে জিতব, কিন্তু ২০০৯-এ ভেঙে পড়া সংগঠন যে এখনও তৃণমূলের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো মেরামত হয়নি, মানছেন সিপিএম নেতাদের অনেকেই। বস্তুত, গত লোকসভা পর্যন্ত যাঁরা সিপিএমের হয়ে ভোট ম্যানেজ করতেন শ্রীরামপুরে, তাঁরা এখন নাম লিখিয়েছেন শাসক দলে। ফলে ভোট কাটাকাটির অঙ্কই আপাতত ভরসা সিপিএমের।

তৃণমূলেরও ভাবনা সেটাই।

gautam bandyopadhyay bappi lahiri
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy