Advertisement
E-Paper

মায়ের আঁচলে বাঁধা টাকাও কি তবে কালো!

রাত ন’টা। খবরটা পেলাম ছেলের ফোনে। পাঁচশো-হাজারের নোট নাকি বাতিল হয়ে গিয়েছে! দূর, এ আবার হয় নাকি! গুজব নিশ্চয়ই। টিভি খুলতেই দেখি, সব সত্যি! সঙ্গে সঙ্গে একরাশ দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরল— ছেলেটা সদ্য ভেলোরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়েছে।

দেবশঙ্কর হালদার

শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৩৮

রাত ন’টা। খবরটা পেলাম ছেলের ফোনে। পাঁচশো-হাজারের নোট নাকি বাতিল হয়ে গিয়েছে! দূর, এ আবার হয় নাকি! গুজব নিশ্চয়ই।

টিভি খুলতেই দেখি, সব সত্যি! সঙ্গে সঙ্গে একরাশ দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরল— ছেলেটা সদ্য ভেলোরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়েছে। ভিন্‌ রাজ্যে একা কী করবে, কী খাবে, কিছু দরকার পড়লে তখন? চলে আসার দিন ও তো টাকা নিতেও চাইল না। দেশ, জাতি, সততা, অসততা ব্যতিরেকে আমার প্রথম যে অভিঘাতটা হল— আচ্ছা ওর কাছে কত টাকা আছে? তড়িঘড়ি ফোন করি। যা ভেবেছি, তাই! ছেলের হাতে মোটে সাতচল্লিশ টাকা রয়েছে! কী হবে এ বার?

লাগাতার বলতে থাকি— কাল হস্টেলেই খাস কিন্তু। আর প্রোজেক্টের জিনিস কিনতে টাকা লাগলে কারও কাছে ধার করে নিস। বলিস, টাকা পেলেই দিয়ে দিবি। নিজের উপরেই রাগ হয়ে যায়। কেন যে ওর কথা শুনতে গেলাম! কেন জোর করে টাকা দিয়ে এলাম না হাতে! অবশ্য দিয়েই বা কী হতো? সেই তো পাঁচশো টাকার নোটই দিতাম! খুচরো বা একশো টাকা নিশ্চয়ই দিতাম না!

টিভির চ্যানেল চষে ফেলি। কী হল, কেন হল শুনেটুনে মনে হল— বাঃ, এ রকম একটা টালমাটাল সময়ে এক জন ভাবতে পারল দেশ স্বচ্ছ হবে, দেশ সৎ হবে? উগ্রপন্থীদের হাতে টাকা যাওয়া, জাল টাকা ইত্যাদি ইত্যাদির মোকাবিলার করার জন্য নিজেকে তো বটেই, গোটা দেশের মানুষকে দাঁড় করিয়ে দিল? এ তো ভারী সাহসের কাজ! ভাবনাগুলোও ফিরে আসে তার মধ্যেই। পকেটে একশো টাকা আছে তো? না থাকলে কী ভাবে পাওয়া যাবে?

আমাদের বাড়িতে এক মহিলা বাড়ির কাজকর্ম করেন বহু বছর ধরে। পারিশ্রমিকের টাকা তিনি নিজেই জমিয়ে রাখেন। বহু বার বলেছি, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে দিই। তবু শুনলে তো! কিছুটা অশিক্ষার জেরে, খানিকটা হয়তো বা আমাদের অবিশ্বাস করেই। ফলে ঠিক একটা মুহূর্তের ঘটনায় এত দিনের জমানো পুঁজি স্রেফ নেই হয়ে গেল! বাতিল টাকা! ওগুলো তো টাকা নয় শুধু, ওগুলো তো ওর জোর, ওর আইডেন্টিটি। টাকা বাতিল করে সেটা এ ভাবে মিথ্যে হয়ে গেল? মন খারাপ লাগে খুব। আমরাও চার ভাই যখন লোন নিয়ে বাড়ি করেছিলাম, আমারও তো হাতে সামান্য একটুখানি টাকা থাকলে, মনে কেমন একটা নিরাপত্তার জোর আসত!

সব এক হয়ে যেতে থাকে। সবক’টা মানুষ। স্ত্রীকে বলতে যাই এ সব। কিন্তু আমার শিক্ষিত, ব্যাঙ্কিং জানা হাউসওয়াইফ স্ত্রী-ও তো সংসার খরচ বাঁচিয়ে কিছুটা টাকা জমায় নিজের কাছেই। ওর হয়তো অসুবিধে হবে না। কিন্তু সংসার ব্যালান্স করে বাঁচানো ওই টাকাটা তো ওর পারদর্শিতা। সে টাকায় তো ওর হক আছে। বড় মায়ামমতার সেই টাকা। অথবা আমার মা? ছোটবেলায় মনে আছে, তখন ব্যাঙ্কের এমন রমরমা ছিল না। মায়ের আঁচলের খুঁটে বাঁধা সংসার খরচের বাঁচানো টাকা ছিল। সেই পুঁজিতে একশো টাকা থাকলে মা-কে কেমন প্রত্যয়ী লাগত যেন— চাইলে চার ছেলে মেয়ের বায়না মেটাতে পারি, সেই আত্মবিশ্বাসটা ঘিরে থাকত।

এগুলো কি কালো টাকা? হয়তো বা। ওই রাতে এমন অনেক আঁচলে বাঁধা টাকার কথা শুনেছি। কিংবা আঁচলের বদলে ছোট খাপে রাখা। তা নিয়ে ভয়ের কিছু ছিল না হয়তো। ব্যাঙ্কে গেলেই বদলেও নেওয়া যাবে। কিন্তু ওই এক মূহূর্তে ওই টাকা বাতিল হয়ে যাওয়া মানে আইডেন্টিটি লস, মানে পায়ের তলার মাটি সরে যাওয়ার দুঃখ। এই দুঃখটা কিন্তু দেখেছি এ ক’দিন রাস্তাঘাটে। আর সেই সঙ্গেই কেমন যেন একটা ধন্দ কাজ করেছে। আমিও তো টাকা বদলাতে যাচ্ছি, আমিও তো কখনও না কখনও বাসে ভাড়া না দিয়ে আনন্দ পেয়েছি, তার মানে কি আমি কালো লোক? প্রধানমন্ত্রী বলছেন, সৎ মানুষের কোনও ভয় নেই। কিন্তু আমি তো ভয় পেয়েছিলাম, তবে কি আমি অসৎ? বাসে টিকিট ফাঁকি দিয়ে গ্লানি তৈরি হয়েছে। পরদিন সেই কন্ডাক্টরকে নিজে ডেকে সেই টাকা মিটিয়ে দেওয়ার আনন্দটাও অনুভব করেছি। আর সেই টাকা ফিরে পেয়ে কন্ডাক্টরও আনন্দ পেয়েছে। কার আনন্দটা বেশি? এই যে সচেতনতা, এটার কথাই কি বলছেন রাষ্ট্রনেতারা? এই বোধটাই কি সকলে মিলে গড়ে তুলতে বলছেন?

তখন মনে হয়েছে, আমরা যাঁরা খানিক লেখাপড়া শিখেছি, আমরা কি পারি না এই সচেতনতাটা গড়ে তুলতে? কিন্তু দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সঙ্গেই কিছু পাল্টা প্রশ্ন করে ফেলি। প্রতিরক্ষা খাতে যে এত টাকা বরাদ্দ হচ্ছে, যে কারণে শিল্পের জন্য টাকা ভিক্ষা করে আনতে হচ্ছে তাতে এমন ফাঁক কেন? সেই ফাঁক গলে কী করে তৈরি হল এত জাল টাকা? আমরা জানতে পারলাম না কেন?

উত্তরটা জানি। আসলে একটা সিস্টেমের সমান্তরালে আর একটা সিস্টেম চলে। সেটা চালায় অসৎ মানুষেরা। এই যে এ ক’দিন আমরা এত মানুষ লাইনে দাঁড়ালাম, ভোগান্তি সইলাম, রাষ্ট্রনেতাদের যদি প্রশ্ন করি, এত দিন সর্বক্ষণ কি তাঁরা সচেতন ছিলেন না? তাঁদের যুক্তি মজুত। তবু বলব, আর একটু ভাবার কি অবকাশ ছিল না? পাল্টা যুক্তিও আছে। তবু একটু সচেতনতা কি রাখা যেত না?

এর মধ্যে এক দিন আমার স্ত্রী ব্যাঙ্কে গিয়েছিল। দীর্ঘ লাইনে লোকে দাঁড়িয়ে। কিন্তু বিরক্তি নয়, বরং গল্পগুজব হচ্ছে। তার মাঝখানেই লাইনে দাঁড়িয়ে এক পাগল। ওর টাকা-পয়সা নেই হয়তো, কিন্তু লাইনে দাঁড়ানোর অধিকার তো আছে। বলছে, ‘‘এই লোকগুলো সব্বাই বোকা। এই যে এত কষ্ট করে টাকা বদলে নেবে, ভাবছে টাকা পাবে আসলে কিন্তু কিচ্ছু পাবে না!’’ কথাটা দার্শনিক। তবু ভাবায়। আজকে এত কষ্টে টাকা বদলানো, কাল সেই বদলানোটা তো বৃথা হয়ে যেতেই পারে!

একটা নাটকের সংলাপ মনে পড়ছে— ‘এক বার দেশে খাবারের অভাব হল। সব্বাই বলতে লাগল— দেশের জন্য কম খা’। অবাক হয়ে বাবাকে প্রশ্ন করি, দেশের লোকটা কে? আমরাই তো! আমি যদি কম খাই, দেশের লোকই তো কম খেল! সরকারের এই পদক্ষেপটার বিরোধিতা করছি না। কিন্তু দিন আনা-দিন খাওয়া মানুষগুলো, ছোটখাটো কাজ করা মানুষগুলো যে বিপদে পড়ল, তাদের একটু স্বাচ্ছন্দ্যে রাখার কথা কি ভাবা যেত না? অবশ্য হ্যাঁ, এটাও ঠিক— দেশ যখন একটা মারাত্মক জায়গায় পৌঁছয়, তখন দেশের জন্য আমাদের সকলকেই এগুলো ভাগ করে নিতে হয়। তখনই এই স্বপ্নগুলো দেখানো হয়। একটা সুন্দর দিনের স্বপ্ন— যেদিন সবাই খেতে পাবে, সবাই পরতে পারবে। ফুটপাথের ছেলেরা এক দিন সিংহাসনে বসবে। এই মুহূর্তে গরিব লোকেরা একটু বিপন্ন জায়গায়। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে দেখছি, ওদের মধ্যে একটা সরলতা, একটা সাহস আছে— যা হোক, লড়ে নেব! সেটাই বা কম কী!

সে দিন আমাদের দলের একটা ছেলের হাওয়াই চটি কিনে নিয়ে আসার কথা ছিল, একটা চরিত্র তা পরে মঞ্চে ঢুকবে। পারেনি। ডিরেক্টরের অনেকটা বকুনি খেয়ে শেষমেশ বলল, পাঁচশো টাকার নোটটা ভাঙাতে পারেনি, তাই আনেনি। ততক্ষণে ওর অনেকটা বকুনি খাওয়া হয়ে গিয়েছে। দোষটা তা হলে কার? ছেলেটার, ডিরেক্টরের, নাকি আচমকা নোট বাতিল হয়ে যাওয়ার!

অনেক আগে আমাদের ছোটবেলাতেও এক বার এ রকমই হয়েছিল। সে বার বোধহয় তখন বন্যা হয়েছে, তার মধ্যে দেশের কারণে এমনই একটা কোনও বিপর্যয়। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। আমার বাবা তখন যাত্রা করেন। সেই রোজগারে অতএব টান পড়ার আশঙ্কা। আমাদের দোতলার বাড়ির একতলাটায় তখন আমাদের পড়ার ঘর, রান্নাঘর। ওই দুর্বিপাকে টাকার সংস্থান করতে অগত্যা নীচের তলাটা ভাড়া দিয়ে দেওয়া হল। আমরা সবসুদ্ধ নিয়ে উঠে গেলাম দোতলায়। ঠাকুরমার ঘরে একটা পার্টিশন দিয়ে রান্নাঘর হল আমাদের। আর হল, সকলের একটু ঘন হয়ে আসা। ভারী মজা হল আমাদের ভাইবোনেদের। দোতলায় রান্না হবে!

কিন্তু দু’তিন দিন পরেই কেমন অন্য রকম লাগল। নীচের তলাটা দেখি আর আমাদের নেই। যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা সবাই ভাল। তবু ঘরগুলো আর আমাদের হাতে নেই! আমরা তখন ছোট। পরিস্থিতিটা ভাল করে বোঝার বয়স হয়নি। তবু একটা ভয় ধাক্কা দিয়েছিল। আর মনে হয়েছিল, এই যে দেশের কারণে আমাদের এমন হল, দেশ যারা চালায়, তারা নিশ্চয়ই আমাদের দেখবে! ঠাকুরমার ঘরের পার্টিশনটা তুলে দিয়ে যাবে!

সে পার্টিশন উঠেছিল অবশ্য, বছর পাঁচেক পরে। টাকার সংস্থান হয়েছিল, দাদা চাকরি পেয়েছিল। তবু ছোটবেলার ওই ধাক্কাটাও মনে গেঁথে গিয়েছিল। একটা ছোট্ট গোছানো সংসার, তাতে একটা পার্টিশন পড়ল। দেশ তার উপর দিয়ে রোলার চালিয়ে দিল। সবাই তবু বলল, সব ঠিক হয়ে যাবে! যন্ত্রণা সহ্য করল, উঠেও দাঁড়াল। কিন্তু দেশ যাঁরা চালান, তাঁরাও সেই সময়ে ওই যন্ত্রণাটা পেয়েছিলেন তো?

গত কালই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি কাব্যনাট্য পড়ছিলাম— ‘দুর্বোধ্য’। তার সংলাপগুলো এ রকম— ‘পৃথিবীতে অলৌকিক বা দুর্বোধ্য কি আর কিছুই নেই? আছে, আছে। ঢের আছে। তবে খাঁটি লৌকিক যদি কিছু খুঁজতে চাও, তার নাম খিদে।...তুমি কী করে জানলে? তুমি কি দিনের পর দিন না খেয়ে থেকেছো?’ ব্যাঙ্কে-এটিএমে যে মানুষগুলো ভোর থেকে লাইন দিয়ে দাঁড়াচ্ছিলেন, তাঁরা কিন্তু দুর্বোধ্য নন। এই যে এত মানুষের এত বিচিত্র জটিলতা, সব কি সরকার রাতারাতি বদলে দিতে পারবে?

চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু ওই যে ছোট্ট ছোট্ট খুঁটে, আঁচলে বাঁধা টাকা, ওগুলোর কথা কি ওই রাতে ভেবেছিলেন বিধি জারি করে দেওয়া রাষ্ট্রনেতারা? এই সাধারণ লোকগুলোই কিন্তু যুদ্ধে যায়, প্রাণ দেয়। ওঁদের কথা ভেবেছিলেন? যাঁদের জন্য স্যালুট ঠুকি, সেই রাষ্ট্রনেতারাও কিন্তু এঁদের মধ্যে থেকেই উঠে এসেছেন।

আমি কিন্তু মানুষের গায়ে গা লাগিয়েই আছি। আমি চাই, স্বপ্ন সত্যি হোক। জীবনের সব না-কাটা টিকিট কেটে অফুরন্ত আনন্দ পেতে চাই। আনন্দ পাব। শুধু ওই লোকগুলোর পাশে লাইনে দাঁড়িয়ে ওই পাগলটার মতো প্রশ্ন করতে চাইব— আমাকে ঠকাচ্ছেন না তো আপনারা?

তবে একটা কথা বলব, এখানে জিতলেও জিৎ, হারলেও জিৎ। সাধারণ মানুষ কিন্তু জিতছেন। প্রতিদিন লাইনে দাঁড়িয়েও, অসহায় হয়েও বলছেন—‘হ্যাঁ ঠিক আছে, পারব, লড়ে যাব!’ তার মানে এ বারেও প্রমাণিত হল— এই সাধারণ, অসহায় মানুষগুলোর শক্তি সব চাইতে বেশি।

Debshankar Haldar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy