Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
মুখ্যসচিবকে নোট ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রীর

বাম জমানার নথি কই, তোলপাড় নবান্ন

বাম জমানার শেষ চার বছরের সঙ্গে নিজের সরকারের চার বছরের তুলনা টানতে চেয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিধানসভা ভোটের মুখে সরকারি পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, উন্নয়নের প্রশ্নে তিনিই সেরা।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৫ ০৪:০৮
Share: Save:

বাম জমানার শেষ চার বছরের সঙ্গে নিজের সরকারের চার বছরের তুলনা টানতে চেয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিধানসভা ভোটের মুখে সরকারি পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, উন্নয়নের প্রশ্নে তিনিই সেরা। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর এই অভিনব পরিকল্পনা রূপায়ণের পথে বিস্তর কাঁটা। বহু দফতরই জানিয়েছে, বাম আমলের শেষ পর্বের নথিপত্র পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ওই সময়ে হওয়া কাজের বিশ্বাসযোগ্য খতিয়ান দেওয়া কঠিন।

এই ঘটনায় বেজায় চটেছেন মমতা। মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রকে নোট দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘নথিপত্র পাওয়া যাচ্ছে না, এই অজুহাত আমি মানি না। যে সব অফিসার তথ্য দিচ্ছেন না, তাঁদের খুঁজে বের করা হোক।’ মুখ্যমন্ত্রীর এই মনোভাবের কথা এই মঙ্গলবারই চিঠি লিখে রাজ্যের অফিসারদের জানিয়ে দিয়েছেন মুখ্যসচিব। আজ, বৃহস্পতিবারের মধ্যে সব দফতরকে বাম আমলের শেষ চার বছরের সঙ্গে মমতা-জমানার চার বছরের তুলনামূলক রিপোর্ট পেশ করতে বলা হয়েছে।

নবান্ন সূত্রের খবর, আসন্ন বিধানসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে ২০১১-’১৫ পর্যন্ত চার বছরে কী কী কাজ হয়েছে, তার ফিরিস্তি দিয়ে দিন পনেরো আগে একটি রিপোর্ট কার্ড তৈরি করতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী। শুধু তা-ই নয়, একই সঙ্গে সিপিএম জমানায় ২০০৭-’১১ সাল পর্যন্ত রিপোর্টও পেশ করতে নির্দেশ দেন তিনি। সেই অনুযায়ী বিভিন্ন দফতর তুলনামূলক রিপোর্ট পাঠাতে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, বেশ কিছু দফতর বাম জমানার শেষ চার বছরের রিপোর্ট পেশ করতে পারেনি। তারা জানিয়ে দেয়, ওই সময়ের উন্নয়নের খতিয়ান তাদের হাতে নেই।

এই ব্যাখ্যা মানতে নারাজ মমতা। নবান্নের এক কর্তা জানান, মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন, আমলা ও কর্মীদের একাংশ এখনও সিপিএমের প্রতি অনুগত। বাম জমানার ব্যর্থতা সামনে আনতে চান না তাঁরা। সেই কারণেই নথিপত্র না-পাওয়ার অজুহাত খাড়া করছেন। মমতার এমন ধারণাও হয়েছে যে, ওই আমলা-কর্মীরা বাম জমানার ব্যর্থতা ঢাকতে ওই সব নথিপত্র নষ্টও করে ফেলে থাকতে পারেন। আর সেই কারণেই সরাসরি মুখ্যসচিবকে কড়া নোট পাঠিয়ে বিষয়টি তদারকের ভার দিয়েছেন তিনি।

সরকারি অফিসারদের উদ্দেশে মুখ্যসচিব যে চিঠিটি লিখেছেন, তাতে মুখ্যমন্ত্রীর নোটের বয়ান হুবহু তুলে ধরা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর নোটে লিখেছেন, ‘বিগত চার বছরে সরকারের কাজকর্মের সঙ্গে আগের সরকারের শেষ চার বছরের কাজের তুলনামূলক রিপোর্ট চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু বেশ কিছু দফতর আগের আমলের রিপোর্ট জমা দেয়নি। বলা হচ্ছে, ওই সময়ের নথিপত্র পাওয়া যাচ্ছে না। এই অজুহাত আমি মানি না। মুখ্যসচিব অনুগ্রহ করে দেখুন, যে তথ্য চাওয়া হয়েছে, সব দফতর যেন তা দেয়। আর যদি নথিপত্র না-মেলে, তা হলে রেকর্ড ঠিকঠাক সংরক্ষণ না করার দায় কার, তা নির্দিষ্ট করুক সংশ্লিষ্ট দফতর।’’

নোটের বয়ান উল্লেখ করার পরে মুখ্যসচিব তাঁর চিঠিতে বলেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর পর্যবেক্ষণ খেয়াল করুন এবং দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন।’’ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ কর্যকর করার জন্য অফিসারদের ১ অক্টোবর পর্যন্ত সময় দিয়েছেন মুখ্যসচিব। অর্থাৎ, আজ, বৃহস্পতিবারের মধ্যে হয় নথি জমা দিতে হবে, না হয় নথি না-থাকার দায় কার, তা নির্দিষ্ট করতে হবে।

সবিস্তার পড়তে ক্লিক করুন।

মুখ্যসচিবের চিঠি সরকারি অফিসারদের মধ্যে রীতিমতো উদ্বেগের সঞ্চার করেছে। তাঁদের একাংশের বক্তব্য, ‘‘গত চার বছরে বিভিন্ন দফতর এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়েছে। অনেক দফতরে জায়গার অভাবে পুরনো নথি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ফলে আট বছর আগের তথ্য অনেক দফতরের কাছে নেই।’’ অফিসারদের কারও কারও আবার দাবি, খুব গুরুত্বপূর্ণ ফাইল ছাড়া সরকারি দফতরে এত পুরনো নথিপত্র রাখা হয় না। ফলে ২০০৭ সাল থেকে সমস্ত নথি না থাকাটাই স্বাভাবিক। এ নিয়ে এখন দায় নির্দিষ্ট করা আরও কঠিন। কারণ, চাকরির শেষ প্রান্তে এসেই রেকর্ড রাখার ভার পান কর্মচারীরা। তাঁদের অনেকেই অবসর নিয়েছেন। ফলে এখন আর কার উপর দায় চাপানো হবে?

অফিসারদের অন্য একটি অংশ আবার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সহমত। তাঁদের কথায়, ‘‘যেখানে পুরো ব্যবস্থাটাই কম্পিউটার পরিচালিত, সেখানে আগের সরকারের চার বছরের রিপোর্ট না থাকাটা অস্বাভাবিক।’’

মমতার ঘনিষ্ঠ এক কর্তার ব্যাখ্যা, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী প্রায়ই বলতেন সিপিএম যাওয়ার আগে সব নথিপত্র নষ্ট করে দিয়েছে। বহু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল সরিয়ে নিয়েছে। এখন রিপোর্ট তৈরি করতে গিয়ে হয়তো সেই তথ্যই বেরিয়ে আসছে।’’ ওই কর্তা জানান, ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই ধর্মতলায় গুলিচালনা সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন তৈরির সময় দেখা যায়, কোনও ফাইল পাওয়া যাচ্ছে না। নন্দীগ্রামের ঘটনার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল।

তৃণমূল শিবিরের অভিযোগ অবশ্য মানতে নারাজ বামেরা। তাঁদের বক্তব্য, সরকার বদলের সময় তো কেউ নথি বগলে নিয়ে বাড়ি চলে যায়নি। সবই মহাকরণে রাখা ছিল। তৃণমূল আমলেই সচিবালয়ের ঠিকানা পাল্টে নবান্ন হয়েছে। বাড়ি বদলের সময় অসাবধানতাবশত যদি কোনও নথি হারিয়ে গিয়ে থাকলে তার দায় মমতার, তাঁদের নয়।

বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের বক্তব্য, ‘‘আগের সরকারের শেষ চার বছরে কী কাজ হয়েছিল তা জানার জন্য আর্থিক সমীক্ষা রিপোর্ট রয়েছে। বিধানসভায় নানা তথ্য নথিভুক্ত রয়েছে। সব এক সঙ্গে হারিয়ে যাবে নাকি!’’ একই সঙ্গে তাঁর কটাক্ষ, ‘‘আমাদের চার বছরের
সঙ্গে ওঁর চার বছরের তুলনা করতে গেলে ওঁকে অস্বস্তিতেই পড়তে হতো। তাই নানা রকম কারণ খাড়া করছেন।’’

এই টানাপড়েনের আবহে আজ, বৃহস্পতিবার বাকি দফতরগুলি রিপোর্ট পাঠাতে পারে কি না এবং না পারলে কারও উপরে শাস্তির খাঁড়া নেমে আসে কি না, তা নিয়েই কৌতূহল তুঙ্গে নবান্নে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE