এই তো ক’দিন আগে কথা। ২৫ নভেম্বর সন্ধেয় লোকে লোকারণ্য বহরমপুর রবীন্দ্র সদন চত্বর।
ব্যাপারটা কী? দিল্লি থেকে একটি দল নাটক করতে এসেছে। দলের নাম ‘থিয়েটারওয়ালা’। নাটকের নাম ‘কোই বাত চলে’। পুরনো চালের রোম্যান্টিক কমেডি। প্রধান ভূমিকায় যশপাল শর্মা। ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার জলপানি পাওয়া অভিনেতা হলে কী হবে? যশপালের নামডাক সিনেমার সুবাদে। তার উপর বহরমপুরের ঘরের ছেলে সন্দীপ ভট্টাচার্যের সতীর্থ। আর দেখতে হল না। কাউন্টার খোলার কয়েক দিনের মধ্যেই হাউস প্রায় ফুল হয়ে গেল! বহরমপুরের এলেমদার নাটকের দল রঙ্গাশ্রমের ৬ষ্ঠ নাট্য সমারোহের মধুরেণ সমাপয়েৎ হল।
ইদানীংকালে নান্দীকারের নাটক ছাড়া এত কাড়াকাড়ি কার নাটক দেখেছে বহরমপুর? মনে করতে পারছেন না সন্দীপের দাদা তথা বহরমপুরের খানদানি নাটকের দল বহরমপুর রেপার্টরি থিয়েটারের নির্দেশক প্রদীপ ভট্টাচার্য। কিছু কাল ঝিমিয়ে থাকার পর প্রদীপের দলও গা-হাত-পা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। নাটক না হয় হল, কিন্তু আর একটা-দুটো নয়, এ বার গোটা শীতকাল জুড়ে ছ’-সাতটা নাট্য উৎসব হচ্ছে বহরমপুরে! চার দশক ফুৎকারে পেরিয়ে যাওয়া নাটকের দল ঋত্বিকের কর্ণধার মোহিতবন্ধু অধিকারী জানালেন, “ছান্দিকের উৎসব শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে না গেলে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত টানা ফেস্টিভ্যাল! এ বছর অন্তত চারটে দল, যারা কখনওই ফেস্টিভ্যাল করে না, তারাও ফেস্টিভ্যাল করছে!” সবেধন নীলমণি রবীন্দ্র সদনের একটিও ‘ডেট’ খালি নেই!
রঙ্গাশ্রমের পালা শেষ হলেই ঋত্বিকের দেশ-বিদেশের নাট্যমেলা। “তারপর ছান্দিক, প্রান্তিক, উজান, গাঙচিল, বহরমপুর রেপার্টরি থিয়েটার!” এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন মোহিতবন্ধু।
দিল্লি দরবারের সিক্কা-মোহরের ঝনঝনানি নেই। সংস্কৃতি মন্ত্রকের দু-তিন লাখ টাকার খয়রাতি কবে দলের অ্যাকাউন্টে এসে জমা হবে, ‘দেবা না জানন্তি’! এখন যা আসছে তা যে ধীরে ধীরে কমে আসবে এ-ও স্পষ্ট। রাজধানীর মুখাপেক্ষী থেকে উৎসব করতে গিয়ে যে সমবায়ী গরজে টান পড়েছিল বুঝছেন সবাই। তবু হঠাৎ কী হল যে এত তেড়েফুঁড়ে নাট্য উৎসবের বান ডেকেছে ভাগীরথী তীরে? কোন আক্কেলে সাড়ে আট লাখ টাকা বাজেট মাথায় নিয়ে উৎসব করছে ঋত্বিক? কোন দুঃসাহসে ছ’দিনের উৎসব করতে গিয়ে সাড়ে চার লাখ টাকার ধাক্কা সামলাচ্ছে রঙ্গাশ্রম? কী করে সিক্কা-মোহরের তোয়াক্কা না করেই তিন পর্বে উৎসব করছে বহরমপুর রেপার্টরি থিয়েটার? কোন ভরসায় নিজেদের ফেস্টিভ্যালে নিজেদের নতুন প্রোডাকশন ‘মাই নেম ইজ গওহরজান’-এর প্রিমিয়ার করতে চলেছে প্রান্তিক?
একটি কারণ অবশ্যই রবীন্দ্র সদন। সংস্কারের জন্যে কিছু দিন বন্ধ ছিল। ধাপে ধাপে খুলেছে। পুরনো প্রেক্ষাগৃহের খোলনলচে বদলানো হয়েছে একটু একটু করে, বছর দু’য়েক ধরে। এতে করে হয়ত কিছু লোক কম আঁটছে, কিন্তু আকাউস্টিক আগের চাইতে ঢের ভাল হয়েছে, ভাল হয়েছে এয়ার-কন্ডিশনিং। ফলে দর্শকদের আকর্ষণ বেড়েছে। ছ’শো আসন ভরাতে দোরে দোরে হত্যে দিতে হচ্ছে না।
দ্বিতীয় কারণ কি রাজনৈতিক থিয়েটারের প্রত্যাবর্তন? বহরমপুরের নাটককে অনেক দিন ধরে দেখছেন এমন কেউ কেউ বলছেন যে এটাই বড় কারণ। লোকে যে কথা বলতে পারছে না, ধরতে পারছে না, নাটকের মধ্যে সেই কথা শুনতে চাইছে। ২০ নভেম্বর সন্ধ্যায় রঙ্গাশ্রমের উৎসবের সূচনা করে বাংলাদেশের বিশিষ্ট অভিনেত্রী রোকেয়া রফিক বেবী বলছিলেন, “কোথাও কোনও অন্যায় হলে আমরা সামনের সারিতে এসে প্রতিবাদে দাঁড়াই। এটা শুধু এপার বাংলা-ওপার বাংলা নয়, সারা বিশ্বেই এটা হচ্ছে। কিন্তু মানবতা কী ভাবে ভূলুণ্ঠিত হতে পারে, কী ভাবে একের পর এক হত্যাযজ্ঞ সংগঠিত হতে পারে তা দেখার পরে আমরা তো চুপ থাকতে পারি না। আমাদের সংস্কৃতির জোর দিয়েই তাকে ঠেকাব।”
আর আছে আত্মবিশ্বাস। “আমাদের দশ দিনের ফেস্টিভ্যালে অন্তত আট দিন হাউসফুল যাবে। সেই অর্গানাইজেশন আমাদের আছে,” বলছেন মোহিতবন্ধু। সন্দীপের সেই সাংগঠনিক জোর নেই। হালে দলের মধ্যে বড়সড় ভাঙন দেখেছেন তিনি। কিন্তু নির্দেশক হিসেবে তাঁর ওস্তাদির সুবাদে দেশে-বিদেশে নানান জায়গায় নাটক নিয়ে গেছে রঙ্গাশ্রম। ভাল নাটক চিনেছেন হাতের তালুর মতো করে। সন্দীপের মনে হচ্ছে, “রঙ্গাশ্রমের ফেস্টিভ্যাল নিয়ে অডিয়েন্সের মনে অদ্ভুত একটা এক্সপেকটেশন তৈরি হয়ে গেছে। সবাই ধরেই নিয়েছে, এরা ভাল নাটক আনে। তাই হলের বাইরে হোর্ডিং পড়লেই লোকে বলতে শুরু করে, ‘টিকিট কবে ছাড়ছো?”
এই ইতিবাচক মনোভাবকে সম্বল করে শহর মাতানোর সংকল্প নিয়েছে বহরমপুরের দলগুলি। দর্শনীর হার বাড়ানো হয়েছে। গত বছরেও যা ২০-৩০ টাকাতে আটকে ছিল, এ বার তা ৫০ ছাড়িয়ে ১০০ টাকাতে পৌঁছে গেছে! “যশপালকে কেউ স্টেজে দেখেনি, সিনেমায় দেখেছে। এই স্টার ভ্যালুতে অনেক নতুন দর্শক আসছে। কেউ কেউ তো ২০-২৫টা করে টিকিট নিয়ে গেছে!” বলছেন সন্দীপ।
রঙ্গাশ্রমের উৎসবের উদ্বোধন করতে এসেছিলেন নট ও নাট্যকার সৌমিত্র বসু। পাশে ছিলেন ঢাকার থিয়েটার আর্ট ইউনিটের অভিনেত্রী রোকেয়া রফিক বেবী। ১০ ডিসেম্বর ঋত্বিকের উৎসবের সূচনা করবেন নাটককার দেবাশিস মজুমদার। থাকবেন বাংলাদেশের প্রমুখ সাহিত্যিক সৈয়দ সামসুল হক, নাট্য সমালোচক রঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়। সমাপনী সন্ধ্যায় থাকবে ঢাকার নামী দল থিয়েটারের এক কালোত্তীর্ণ প্রযোজনা ‘মেরাজ ফকিরের পালা’। সেই সূত্রে বহরমপুরে পা রাখবেন নট-দম্পতি রামেন্দু মজুমদার ও ফেরদৌসি মজুমদার।
২০ নভেম্বর সন্ধ্যায় সৌমিত্র বলছিলেন, “আজ যখন আমাদের দেশে, আমাদের প্রতিবেশী দেশে খুব অনায়াসে এক জন মানুষ আর এক জন মানুষকে গুলি করে দিতে পারে, এক জন রক্তাক্ত মুমূর্ষু মানুষকে বাঁচাতে না এগিয়ে সেলফোনে তার ছবি তুলতে পারে, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে শিল্পই হল সেই অস্ত্র যা দিয়ে এই শক্তিকে প্রতিহত করার চেষ্টা করা যায়।”
এই কাজটিই খুব গুছিয়ে করতে চাইছে বহরমপুর!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy