প্রযোজকদের দাবি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়ে শ্রীকান্ত অন্যায় সুবিধা নিচ্ছেন। অথচ ইন্ডাস্ট্রির ছোট প্রযোজক থেকে ডিস্ট্রিবিউটর-এগজিবিটর কেউই তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারছেন না। এই জন্যই তৈরি করা হয়েছে বিএফটিসিসি। শুক্রবার দুপুরে লেনিন সরণির অফিসে বসে প্রযোজক অশোক ধানুকা বললেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর আমাদের পুরো আস্থা রয়েছে। কিন্তু এক জন প্রোডিউসর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে ভয় দেখিয়ে একটার পর একটা সুবিধা নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের ধারণা, টলিউডের দেখভালের জন্য যিনি মন্ত্রী রয়েছেন, সেই অরূপ বিশ্বাসও পুরো ঘটনা জানেন না।’’ শ্রীকান্তের উদ্দেশে অশোকবাবুর সরাসরি তোপ, ‘‘ওই ব্যক্তির একটাই উদ্দেশ্য, সরকার থেকে জমি নেওয়া। উনি চান, এই ইন্ডাস্ট্রিতে যেন শুধু তিনি থাকেন আর বাকি সব প্রযোজক মারা যান।’’ এ ব্যাপারে অরূপ বিশ্বাসের প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
ভেঙ্কটেশ ফিল্মস-এর সঙ্গে অন্য প্রযোজনা সংস্থাগুলির বিরোধ অবশ্য কোনও নতুন ঘটনা নয়। তবে সম্প্রতি দু’টি বিতর্ককে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়েছে। কী রকম? কিছু দিন আগে লন্ডনে অশোক ধানুকার একটি ছবির শ্যুটিং আটকে যায়। ধানুকার অভিযোগ, টালিগঞ্জের টেকনিশিয়ান্স অ্যাসোসিয়েশনের উপরে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে চাপ দিয়েই শ্যুটিং বন্ধ করা হয়েছিল। টেকনিশিয়ান্স অ্যাসোসিয়েশনের নিয়ম হল, বিদেশের শ্যুটিংয়ে কমপক্ষে ১৯ জন টেকনিশিয়ানকে নিয়ে যেতে হবে। মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের ভাই স্বরূপ বিশ্বাস ওই অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান। ধানুকার দাবি, ‘‘১৬ জনের ভিসা এসেছিল। বাকি তিন জন পৌঁছয়নি বলে আমাদের শ্যুটিং বন্ধ করে দেওয়া হল। যেহেতু আমি ভেঙ্কটেশের বিরুদ্ধে, তাই আমাকেই টার্গেট করা হল।’’ তাঁর অভিযোগ, স্বরূপ বিশ্বাসদের উপর এ নিয়ে চাপ তৈরি করেছিল ভেঙ্কটেশ। কিন্তু অশোকবাবুর কেন মনে হচ্ছে, তাঁকে আলাদা করে ফাঁসানো হল? তাঁর দাবি, কিছু দিন আগে নিসপাল সিংহ রানের একটি শ্যুটিং হয়েছে ব্যাঙ্ককে। ‘‘ওরাও সব টেকনিশিয়নকে নিয়ে যায়নি। কিন্তু যেহেতু ওরা ভেঙ্কটেশের ঘনিষ্ঠ, তাই ওদের সাত খুন মাফ!’’ এ দিকে লন্ডনে শ্যুটিংয়ে ঝামেলার পর আরও সক্রিয় হয়েছে ফেডারেশন অব সিনে টেকনিশিয়ান্স অ্যান্ড ওয়ার্কার্স অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া। প্রযোজকরা যাতে কোনও ভাবেই কম লোক নিয়ে বিদেশে না যেতে পারেন, তাই এ বার থেকে ছবির হিরো-হিরোইন সহ বাকি অভিনেতাদের পাসপোর্টও জমা দিতে হবে তাঁদের অফিসে— এই মর্মে আর্টিস্ট ফোরামকে চিঠি দিয়েছে ফেডারেশন। এ নিয়ে আর্টিস্ট ফোরামের একটা বড় অংশ খুশি নয় বলেই খবর।
টেকনিশিয়ানদের এই ঘটনাটির সঙ্গে যোগ হয়েছে ডিজিটাল প্রোজেকশনকে কেন্দ্র করে পুরনো বিবাদ। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব সিনেমা হলেই গত দশ বছর ধরে ডিজিটাল প্রোজেকশনের সাহায্যে ছবি দেখানো হয়। এই প্রোজেকশন দেখায় দু’টি সংস্থা— কিউব এবং ইউএফও। এখানে কিউব প্রোজেকশনের
একমাত্র ডিস্ট্রিবিউটর ভেঙ্কটেশ ফিল্মস। ইউএফও-র দায়িত্বে রয়েছে অন্য সংস্থা। এই নিয়েও ভেঙ্কটেশের বিরুদ্ধে নালিশ রয়েছে প্রযোজকদের। রানা সরকার যেমন বলছেন, ‘‘ভারতের বাকি সব জায়গায় প্রাদেশিক ছবির জন্য কিউবকে দিতে হয় ২৫০ টাকা প্রতি শো। হিন্দি ছবির ক্ষেত্রে ৪৯০ টাকা প্রতি শো। পশ্চিমবঙ্গেও হিন্দি ছবির জন্য ৪৯০ টাকাই দিতে হয়। কিন্তু বাংলা ছবি হলেই সেই অঙ্কটা হয়ে দাঁড়ায় প্রতিটি প্রেক্ষাগৃহে থোক কুড়ি হাজার টাকা।’’ অর্থাৎ? প্রিয়া সিনেমা হল-এ যদি প্রতিদিন ‘বজরঙ্গি ভাইজান’-এর একটি শো থাকে, তা হলে সপ্তাহান্তে খরচ হচ্ছে ৩৪৩০ (৪৯০ x ৭) টাকা। আর বাংলা ছবি হলেই সেটা দাঁড়াচ্ছে কুড়ি হাজার টাকা। ছবি এক দিন চললেও কুড়ি হাজার, পাঁচ সপ্তাহ চললেও তা-ই।
প্রযোজকরা তবে ইউএফও-র দ্বারস্থ হচ্ছেন না কেন? রানার অভিযোগ, ‘‘প্রথমত এ রাজ্যে ইউএফও-র বাজার কিউবের অর্ধেক। দ্বিতীয়ত, ইউএফও-র খরচও কম নয়। ভেঙ্কটেশ নিজে কিউবের দাম কমাবে না বলে ইউএফও-র উপরেও চাপ তৈরি করে রেখেছে, যাতে ওরাও দাম না কমায়। ফলে ব্যাপারটা যা দাঁড়িয়েছে তাতে নিজেদের ছবি না হলেও প্রায় সব বাংলা ছবি থেকেই ভেঙ্কটেশ বছরে দশ কোটি টাকার কাছাকাছি মুনাফা করছে।’’
এত দিন আপনারা সরব হননি কেন? ধানুকার জবাব, ‘‘আমরা প্রথম দিন থেকেই এর বিরোধী। এ জন্য আমি সস্তার একটি অন্য ডিজিটাল প্রোজেকশনও বাজারে এনেছি।
যার নাম ইউএমডব্লিউ। কিন্তু ভেঙ্কটেশ সব হল-মালিককে ভয় দেখাচ্ছে, যাতে তারা এই নতুন সিস্টেম না লাগায়। ইম্পা-তে প্রোডিউসর সেকশনের সভাপতি পিয়া সেনগুপ্তকে আমরা এটা জানিয়েছিলাম।
কিন্তু যেহেতু তাঁর ছেলেকে ভেঙ্কটেশ নায়ক হিসেবে লঞ্চ করেছে, তাই তিনি আমাদের স্বার্থটা দেখছেন না!’’ প্রযোজক প্রদীপ চুড়িয়াল-ও একই সুরে বলছেন, ‘‘আমাদের স্বার্থ কেউ দেখে না বলেই আমরা আলাদা সংস্থা বানাতে বাধ্য হয়েছি। ভেঙ্কটেশ পশ্চিমবঙ্গে একচেটিয়া রাজত্ব কায়েম করছে। আমরা এমআরটিপি অ্যাক্টে ওদের বিরুদ্ধে মামলা করতেও পিছপা হব না।’’ কৌস্তুভ রায় বলছেন তিনিও বিএফটিসিসি-র সদস্য হতে চান। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমি অনেক দিন ধরে কিউব নিয়ে সরব। আমি আলাদা করে ওদের কাছ থেকে একটা রেট বার করেছি। কিউবকে বলেছি, সব প্রযোজকই যেন এই কম রেটের সুবিধা পায়।’’