Advertisement
E-Paper

খেলার টাকায় জলসা, ঘর বানিয়ে উপার্জনও

বলা হচ্ছে এক। কার্যক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রে হচ্ছে অন্য রকম। খেলাধুলোকে শিকেয় তুলে ক্লাবে অনুদানের সরকারি টাকা কার্যত বহু ভূতে লুটে-পুটে খাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:০৬

বলা হচ্ছে এক। কার্যক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রে হচ্ছে অন্য রকম। খেলাধুলোকে শিকেয় তুলে ক্লাবে অনুদানের সরকারি টাকা কার্যত বহু ভূতে লুটে-পুটে খাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এবং পুরো বিষয়টির নেপথ্যে শাসকদলের ভোট কুড়োনোর প্রয়াসের পাশাপাশি স্থানীয় যুব সম্প্রদায়কে হাতে রাখার তাগিদ দেখতে পাচ্ছেন অনেকে।

রাজ্যে খেলাধুলোর পরিকাঠামো উন্নয়ন ও গ্রামাঞ্চল থেকে নতুন খেলোয়াড় তুলে আনার লক্ষ্যে বাছাই করা বিভিন্ন ক্লাবকে অনুদান দেওয়ার প্রথা চালু করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। ক্ষমতায় আসা ইস্তক তারা প্রায় বারো হাজার ক্লাবকে এই বাবদ চারশো কোটি টাকা দিয়েছে। জনগণের করের টাকা এ ভাবে দাতব্য করার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বারবার। রাজ্য সরকারের দেদার বেহিসেবি খরচ, আর তা সামাল দিতে ফি-মাসে দেনা করার কু-অভ্যাস সম্পর্কে প্রিন্সিপ্যাল অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল (পিএজি)-এর অফিসও গত ক’বছর ধরে হুঁশিয়ারি দিচ্ছে। পিএজি’র বক্তব্য: মেলা-খেলা-উত্‌সব-পুরস্কার, ইমাম-মোয়াজ্জিনদের ভাতা, সৌন্দর্যায়ন, নীল-সাদা রং কিংবা হাজার হাজার ক্লাবকে টাকা বিলি করতেই সরকারের ভাঁড়ার ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। উপরন্তু এতে রাজ্যের দীর্ঘমেয়াদি কোনও লাভেরও সম্ভাবনা নেই।

তাই অবিলম্বে খয়রাতির পালায় রাশ টানার পরামর্শ। যদিও নবান্ন কান দিতে নারাজ। সম্প্রতি নেতাজি ইন্ডোরের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ক্লাবগুলো প্রথম বছরে পাবে দু’লাখ টাকা। পরের চার বছর এক লাখ করে। মুখ্যমন্ত্রীর যুক্তি: এক বার টাকা দিয়ে থেমে গেলে ক্লাবগুলোর পক্ষে ক্রীড়া-পরিকাঠামো তৈরির কাজ সম্পূর্ণ করা সম্ভব নয়।


সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...

অগত্যা বছর বছর অনুদানের স্রোত। কিন্তু সেই টাকার গতি কী হচ্ছে?

খোঁজ-খবর চালিয়ে ক্রীড়া উন্নয়নের প্রয়াস যত না চোখে পড়ছে, তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি সামনে আসছে অন্যান্য কাজের বহর, যেগুলোর সঙ্গে খেলাধুলোর সামান্যতম যোগও খুঁজে পাওয়া কঠিন। যেমন, কোনও ক্লাব অনুদানের টাকায় পুজো করছে। কোথাও রক্তদান শিবির, বস্ত্র বিতরণের আয়োজন হচ্ছে। কোথাও সেজে উঠছে মন্দির। কোথাও আবার বসছে জমাটি জলসা— সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামে ভরপুর নাচ-গানের আসর। এমনকী, খেলার টাকায় দালান বানিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভাড়া দিয়ে সদস্যদের স্থায়ী রোজগারের ব্যবস্থাও পাকা করে ফেলেছে অনেক ক্লাব। কিছু ক্লাব অবশ্য তা-ও করেনি বলে অভিযোগ। এলাকায় কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, সরকারের টাকা সেখানে স্রেফ ফুর্তি-মোচ্ছবেই উড়ে গিয়েছে!

অন্য দিকে খেলাধুলোর সঙ্গে সত্যিই জড়িত বহু যোগ্য ক্লাবকে ‘রাজনৈতিক কারণে’ অনুদানে বঞ্চনার নালিশও মজুত। সব মিলিয়ে ক্লাবে অনুদানের পুরো বিষয়টি ঘিরে বিতর্ক-ক্ষোভের আঁচ যথেষ্ট। বিরোধীরা তো বটেই, সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর একাংশেরও পর্যবেক্ষণ, মুখ্যমন্ত্রী তথা প্রশাসন এ সব সম্পর্কে বিলক্ষণ অবহিত। ‘‘এটা আসলে খেলাধুলোর উন্নয়নের ধুয়ো তুলে সরকারি দাক্ষিণ্য বিলি। ক্লাবের ছেলেপুলের মনোরঞ্জনের ঢালাও বন্দোবস্ত হচ্ছে। সবই ভোট-রাজনীতির কথা ভেবে।’’— প্রতিক্রিয়া বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্যের। সিপিএমের মহম্মদ সেলিমের কটাক্ষ, ‘‘সরকার টাকা ছড়িয়ে যুবকদের বিপথে ঠেলে দিচ্ছে। তাদের দিয়ে ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী বানানো হচ্ছে। অথচ যারা সত্যি খেলাধুলোয় জড়িত, তারা কিছু পাচ্ছে না!’’

বস্তুত বিভিন্ন ক্লাবের কর্মকর্তাদের বয়ানেও পরিষ্কার, ক্রীড়া-পরিকাঠামো উন্নয়নের টাকার বেশিটাই আদতে অন্য ভাবে বেরিয়ে যাচ্ছে। যেমন পশ্চিম মেদিনীপুরের লক্ষ্মণপুর নিউ অ্যাথলেটিক। সরকারি টাকায় কী করছেন জানতে চাইলে প্রথমে এক চোট হেসে নিলেন ক্লাবের সম্পাদক তথা তৃণমূলের স্থানীয় নেতা সনৎ মাহাতো। বললেন, ‘‘রক্তদান শিবির হয়েছে। গরিবদের কাপড় দিয়েছি। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতাও হয়েছে।’’ বর্ধমানের বারাবনির আমলাপুর দাদাভাই ক্লাবের রেজিস্ট্রেশন ছিল না ছ’মাস আগেও। অনুদান-তালিকায় নাম তুলতে তড়িঘড়ি রেজিস্ট্রেশন করানো হয়েছে, টাকাও মিলেছে। সম্পাদক মিঠুন দাসের স্পষ্ট কথা, ‘‘আমরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করি। তাতেই টাকাটা খরচ হবে। অনেক সামাজিক কাজকর্মও হবে।’’

‘সামাজিক’ ওই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে খেলাধুলোর কোনও সম্পর্ক থাকবে, এমন ইঙ্গিত অবশ্য মেলেনি। বীরভূমের রামপুরহাট বিবেকানন্দ রোড যুবকবৃন্দেও তা-ই। তৃণমূলের ক্লাব হিসেবে পরিচিত প্রতিষ্ঠানটি ক্রীড়া-পরিকাঠামো তৈরির টাকা নিয়ে মন্দির বানিয়েছে। স্থানীয় বিধায়ক আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্লাব ‘তরুণের আহ্বান’-এ শুরু হয়েছে স্থায়ী পুজোমণ্ডপ নির্মাণের কাজ। আলিপুরদুয়ার সঙ্ঘশ্রী ক্লাবও খেলাধুলোয় যুক্ত না-থেকে টাকা পেয়েছে বলে অভিযোগ। ঘটনাচক্রে ওই ক্লাবেই তৃণমূলের জেলা পার্টি অফিস, এবং ক্লাবের সম্পাদক স্বয়ং তৃণমূল জেলা সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তী। যাঁর বক্তব্য, ‘‘আমরা এ বার টাকা পাইনি। ২০১৩-য় দু’লক্ষ পেয়েছিলাম। আমাদের জিম রয়েছে।’’ আলিপুরদুয়ার পল্লিমঙ্গল সঙ্ঘও খেলাধুলোর জন্য বিশেষ পরিচিত নয়। তা-ও অনুদান জুটেছে। “একটা বড় ঘর বানিয়ে ডাক বিভাগকে বসতে দেওয়া হয়েছে। এতে মানুষের সুবিধে হবে।’’— দাবি সদস্য সূর্য দত্তের।

এমতাবস্থায় শাসকদলের অনেক শীর্ষ নেতাও জনান্তিকে কবুল করছেন যে, খেলাধুলোর টাকা অধিকাংশ জায়গায় ভিন্ন পথে খরচ হচ্ছে। রাজ্যের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর কথায়, ‘‘আমাদের পাড়ায় একটা ক্লাবের মাঠই নেই। কাজ বলতে শুধু দুর্গাপুজো। ওরাও তো গত চার বছর ধরে টাকা পেয়ে আসছে!’’ শিলিগুড়ির ক্লাব-অনুদানের তালিকায় যেন মন্ত্রীর বয়ানের হুবহু প্রতিফলন। জেলা যুব ক্রীড়া বিভাগ সূত্রের খবর: খেলাধুলোর উন্নয়নের জন্য এ বছর দু’লক্ষ টাকা করে দেওয়া হয়েছে শিলিগুড়ির বারোটা ক্লাবকে, যার অন্তত চারটের সঙ্গে খেলাধুলোর কোনও সম্পর্কই নেই। তারা মূলত পুজোর উদ্যোক্তা। ওরা টাকা পেল কোন যুক্তিতে?

জেলা যুব ও ক্রীড়া আধিকারিকদের মুখে কুলুপ। প্রসঙ্গত, ক্লাব-অনুদানের অর্থের জোগান আসছে রাজ্য ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ দফতরের পরিকল্পনা খাতে বরাদ্দ থেকেই। দফতরের নিয়ম অনুযায়ী, আগের বছরের টাকা যথাযথ খরচ হয়েছে কি না যাচাই করে পরের বছরের টাকা দেওয়া হবে। যাচাইপর্ব ঠিকঠাক হয়ে থাকলে ওই সব ক্লাব কী ভাবে টাকা পেল, তার সদুত্তর কিন্তু দফতরের কর্তাদের কাছে নেই।

পরিস্থিতি দেখে নবান্নের একাংশের আক্ষেপ, খেলাধুলোর উন্নয়ন মুখের কথা। আসল উদ্দেশ্য পাইয়ে দেওয়া। ‘‘পশ্চিমবঙ্গে কবাডি, সাঁতার, অ্যাথলেটিকস, টেবিল টেনিসের মতো খেলার চর্চা চলে মূলত সরকারি অনুদানে। অথচ তাদের বাদ দিয়ে বরাদ্দের সিংহভাগ ক্লাবগুলোর পিছনে ঢালা হচ্ছে। আর সেই টাকার বেশিটাই খরচ হচ্ছে স্রেফ অকাজে।’’— বলছেন এক কর্তা।

পাশাপাশি ক্লাব বাছাই নিয়েও বিস্তর ক্ষোভ বিভিন্ন মহলে। বস্তুত অনুদানপর্বের গোড়াতেই অভিযোগ উঠেছিল, শাসক ঘনিষ্ঠ না-হলে টাকা মিলবে না, অথচ শাসকের নেকনজরে থাকলে ভুঁইফোড় ক্লাবেরও কপাল খুলবে। গত চার বছরে এই নালিশের বহর বহু গুণ বেড়েছে বই কমেনি। মেদিনীপুর স্পোর্টসম্যান রিক্রিয়েশনের সহ সভাপতি অশোক ঘোষ যেমন বলেছেন, “আমাদের ক্লাবের পত্তন স্বাধীনতার আগে। আমাদের ফুটবল টিম রাজ্যের নানাজায়গায় খেলেছে। তবু অনুদান পাইনি। কারণ, আমাদের বাইক-বাহিনী নেই!” দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়ায় শ্রীরামপুর কল্যাণ সমিতিও বঞ্চনার অভিযোগ এনেছে। ‘‘ক্রীড়া দফতরের সব শর্ত মেনে আবেদন করেছিলাম। টাকা পাইনি। হয়তো সরকারের আমাদের পছন্দ নয়।’’— মন্তব্য সম্পাদক অশোক কর্মকারের। তাঁদের দাবি, পাশের পাড়ার একটা ক্লাবঘর অনুদানের টাকায় দোতলা হয়ে বিয়েবাড়ির জন্য ভাড়া খাটছে। বালির বারবেল ক্লাবের সদস্যদের খেদ, ভারোত্তোলনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে সাফল্য থাকা সত্ত্বেও অনুদান মেলেনি। সম্পাদক মনোজকান্তি দাস বলেন, ‘‘পঞ্চাশ বছরের পুরনো আমাদের ক্লাব। দু’বার আবেদন জমা দিয়েছি। বারবারই নাকি নাম কেটে যাচ্ছে!’’

এই সব অভিযোগ সম্পর্কেও দফতরের কোনও কর্তার প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে নবান্নের অন্দরমহলের ইঙ্গিত, মুখ্যমন্ত্রী নিজেই যে হেতু হাত উপুড় করে রেখেছেন, তাই নিয়ম মানার কড়াকড়ির বালাই থাকছে না কারও। প্রশাসন-সূত্রের খবর: যুব দফতর স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়কে জিম তৈরির টাকা দেয়। খেলার মাঠ বা মিনি ইন্ডোর বানাতে জেলা প্রশাসন টাকা পায়। তবে সেখানে কী জিনিস লাগবে, কোথা থেকে কেনা হবে, দাম কী হতে পারে— সব বেঁধে দেওয়া আছে। তাই টাকা নয়ছয়ের সুযোগ কম। কিন্তু ক্লাবের ক্ষেত্রে তেমন কিছু নেই। ‘‘এখানে টাকা খরচের যেমন-তেমন একটা হিসেব খাড়া করে দিলেই হল। কেউ অত দেখে না।’’— মন্তব্য প্রশাসনের এক কর্তার।

ফল যা হওয়ার তা-ই।

financial aid clubs controversy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy