একেই বোধ হয় বলে গাঁধীগিরি! ভোটের সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের দ্বৈরথ এখনও স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। কিন্তু জেতার পর এ বার সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদীর কাছে তিন ঝুড়ি আম পাঠালেন। হিমসাগর, ল্যাংরা, ফজলি—পশ্চিমবঙ্গের নানা ধরনের আম। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার একা নন, কমিশনের ঘরে ঘরে অফিসাররা রাজ্যের আমের স্বাদ নিচ্ছেন।
ভোটের সময় কমিশন যা যা করেছে— অফিসার বদলি থেকে শুরু করে আধাসামরিক বাহিনীর কার্যকলাপ, সেই সব কিছু নিয়ে কমিশনের কাছে লিখিত ভাবে অভিযোগ জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে মুকুল রায় সেই সব অভিযোগ নিয়ে সবিস্তার আলোচনা করেছেন। কিন্তু তখনও অভিযোগের পাশাপাশি অগ্রাধিকার পেয়েছে এই আমের কূটনীতি। পশ্চিমবঙ্গের রেসিডেন্ট কমিশনার আমের ঝুড়ি পাঠিয়েই ক্ষান্ত হননি। জনপথে রাজ্য সরকারের যে আম উৎসব হচ্ছিল, সেখানে গিয়েও তিনি আম খাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন জৈদীকে।
এ হেন আম কূটনীতিতে এখন আপ্লুত মুখ্য নির্বাচন কমিশনার। তাঁর বক্তব্য, নির্বাচনে তিনি যা করেছেন, সেগুলি কোনও দলকে জেতানো বা হারানোর জন্য নয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অভিযোগের ভিত্তিতে তিনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন মাত্র। গণতন্ত্রের কাছে তিনি দায়বদ্ধ। আর তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপুল জয়ের পর তিনি শুভেচ্ছা বার্তাও পাঠিয়েছেন নবনিযুক্ত মুখ্যমন্ত্রীকে।
আমের কূটনীতি অবশ্য নতুন নয়। মোগল আমলে আকবর-প্রবর্তিত দিন-ইলাহি ধর্মে যাঁরা যাঁরা আসতেন, তাঁদেরও আম দেওয়া হত। সাম্প্রতিক অতীতে পারভেজ মুশারফ থেকে নওয়াজ শরিফ আমের বাক্স পাঠাতেন প্রধানমন্ত্রী ও অন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের। সলমন খুরশিদ ও বিজেপির অন্য অনেক নেতাও আম বিনিময় করেন। কূটনীতির সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে আম তাই সব সময়েই একটি বড় ভূমিকা পালন করে এসেছে।
মমতার এই গাঁধীগিরি অবশ্য তাঁর দ্বিতীয় ইনিংসের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য বলে মনে করছেন দিল্লির রাজনৈতিক নেতারা। নবনিযুক্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুরেন্দ্রসিংহ অহলুওয়ালিয়া তাঁকে ফোন করলে তিনি ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। এমনকী, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দার্জিলিঙে আসার অনুরোধও জানিয়েছেন। এতেও আশার আলো দেখছেন অহলুওয়ালিয়া। এ বারের ভোটে পাহাড়ে তৃণমূল প্রার্থীরা না জিতলেও যে ভাবে নিজেদের ভোট বাড়িয়ে নিয়েছেন, আর যে ভাবে মমতা এত বার দার্জিলিং গিয়েছেন, তাতে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার প্রধান বিমল গুরুঙ্গকেও এখন গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের চেয়ে জোর দিতে হচ্ছে পাহাড়ের উন্নয়নে। আর সেই উন্নয়নের জন্য কেন্দ্র-রাজ্য দুপক্ষকেই দরকার। ফলে কেন্দ্র-রাজ্য-গুরুঙ্গ সমীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারেন সুরেন্দ্র।
গুরুঙ্গের আন্দোলনকে কার্যত স্তিমিত করে দিয়েছেন মমতা। হরকা বাহাদুরকে দিয়ে ভাঙনও ধরিয়েছেন তাঁর দলে। ভোটেও প্রবল চাপের মধ্যে রেখেছেন। ভোটে জেতার পরে মমতা এখন গুরুঙ্গকে সব রকম সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। এ-ও মমতার এক অভিনব গাঁধীগিরি।
নবান্নে তাঁর দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করার পর অনেকেই বলছেন, এ বার তাঁর আচরণেও অনেক ভিন্নতা এসেছে। তিনি কথায় কথায় সংবাদমাধ্যমের কাছে কোনও বিবৃতি দিচ্ছেন না। ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে পরেই সল্টলেকে গণধর্ষণ হলে তিনি আগের মতো কোনও বিবৃতি না দিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। এবং দোষীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। মূলত স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশ কমিশনার এবং ডিজি পুলিশের মতো শীর্ষ চার জন অফিসারের মাধ্যমে যোগসূত্র রক্ষা করছেন মুখ্যমন্ত্রী। এসএমএস করে নয়, অফিসারদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফোন করে নির্দেশ দিচ্ছেন।
দিল্লিতে মুখ্যমন্ত্রী এবং বিভিন্ন রাজ্যের মন্ত্রীদের সম্মেলনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের দিল্লিতে পাঠাতে শুরু করেছেন। প্রত্যেকটি দফতরের কাজের মূল্যায়ন নিচ্ছেন বিভিন্ন অফিসারদের কাছ থেকে। দিল্লি আশা করছে, মমতা এ বার সংসদের বাদল অধিবেশনেও এই গাঁধীগিরির অস্ত্র নিয়েই এগোবেন। নতুন সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী অনন্ত কুমার বলেন, ‘‘তৃণমূলের লোকসভা ও রাজ্যসভা নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিল নিয়ে আলোচনা করব। সম্ভব হলে অধিবেশন শুরুর আগেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরামর্শ নেব।’’
আম দিয়ে যে গাঁধীগিরি মমতা শুরু করেছেন, সেটি নিয়ে কী এ বারে বিজেপির সঙ্গেও এগোবেন মুখ্যমন্ত্রী?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy