উত্তরপাড়া থেকে চাঁপদানি— এই ছবি ক্রমশ কমছে। নিজস্ব চিত্র।
উন্নয়নের আলোয় কিছু আঁধার ঘনিয়েই আসে—অর্থনীতির এই চেনা তত্ত্বে হুগলির ৬টি পুর এলাকার হাজার কয়েক বর্জ্য-কুড়ানির দিনযাপনে ছায়া ফেলেছে কেএমডিএ-র একটি বর্জ্য প্রকল্প।
সাত সকালে আধ-ময়লা ঝোলা কাঁধে বেরিয়ে পড়লেও উত্তরপাড়া থেকে চাঁপদানি—বিভিন্ন বস্তিতে ছড়িযে ছিটিয়ে থাকা প্রায় সাড়ে বারো হাজার আবর্জনা-জীবী মানুষের চেনা ‘আস্তাকূঁড়ে’ রোজগারের উপকরণের উপরেই ঝুলে গিয়েছে প্রশ্ন চিহ্ন।
বৈদ্যবাটির অদূরে দীর্ঘাঙ্গিতে কেএমডিএ-র উদ্যোগে ওই প্রকল্প প্রায় চালু হওয়ার মুখে। এ ছাড়াও, জিটি রোড বরাবর গায়ে-গা লাগানো, উত্তরপাড়া-কোতরং, বৈদ্যাবাটি, রিষড়া, কোন্নগর, শ্রীরামপুর এবং চাঁপদানি পুরসভার নির্দিষ্ট এলাকায় পুনর্ব্যবহার যোগ্য যাবতীয় আবর্জনার জন্য আলাদা প্ল্যান্ট গড়ারও পরিকল্পনা রয়েছে কেএমডিএ-র।
২০০৮ সালে কেএমডিএ-র সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ‘জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি’র (জাইকা) পৃষ্টপোষকতায় ওই প্রকল্পগুলির কাজও প্রায় শেষের পথে। চলতি বছরের নভেম্বরে ওই প্রকল্পগুলি একই সঙ্গে বর্জ্য থেকে পুনর্ব্যবহার যোগ্য সার তৈরির কাজ শুরু হওয়ার কথা। দীর্ঘাঙ্গির ৫১ একর বিস্তৃত জমিতে অবশ্য শুধুই অব্যবহারযোগ্য আবর্জনা মাটিতে পুঁতে পেলা হবে।
কিন্তু ছ’টি পুর এলাকায় পরিচ্ছন্নতা ফেরানোর আশার আলোয় আঁধার দেখছেন আবর্জনা খুঁটে বেঁচে থাকা পরিবারগুলো। কেন?
চাঁপদানির আয়েশা খাতুন (নাম পরিবর্তিত) কিংবা বৈদ্যবাটির উমাপ্রসাদ যাদব জানাচ্ছেন, আবর্জনার মধ্যে থাকা প্লাস্টিক, কাচ কিংবা লোহার টুকরো দিনভর কুড়িয়ে বাজারে কেজি দরে বিক্রি করেই আয়ের উপায় খোঁজেন তাঁরা। প্রকল্প চালু হওয়ার পরে শহরে আবর্জনা হারিয়ে যাওয়ায় তাঁদের রুজির ‘উপকরণ’ খোয়া গিয়েছে। মধ্য চল্লিশের সীতারাম যাদবের তাই প্রশ্ন, ‘‘আবজর্না হারিয়ে গেলে পেট ভরবে কী করে?’’
নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বিষয়টি জানেন। তিনি বলেন, ‘‘ওই প্রকল্পগুলির দায়িত্বে রয়েছে কেএমডিএ-রই একটি বিশেষজ্ঞ সংস্থা। বিশেষজ্ঞ রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়ের তত্ত্ববধানেই একই সঙ্গে প্রকল্পের বিভিন্ন কাজের পাশাপাশি বর্জ্য-নির্ভর পরিবারগুলির সামাজিক পুনর্বাসনের ব্যাপারেও কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করছেন ওই সংস্থাটি।’’
ওই সংস্থার সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ছেঁড়া পলিব্যাগ, নরম পানীয়ের ত্যাবড়ানো বোতল, বাতিল যন্ত্রাংশ কিংবা আধ-বেঁকা সিরিঞ্জ— আবর্জনার স্তূপ থেকে রুজির পরিচিত উপকরণ কুড়িয়ে আশপাশের প্লাস্টিক কিংবা বাতিল যন্ত্রাংশের আড়তে বিক্রি করেই দিন গুজরান করে ওই পরিবারগুলো। দিনে ২ থেকে ১২ ঘণ্টা খেটে তাদেরও আয়ও মন্দ নয়।
তাদের গড় আয় দিনে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। কারও বা ৬০০ টাকাও বেশি। শ্রীরামপুরের ফরিদ আহমেদ দাবি করেছেন দিল্লি রোডের দু-পাশে স্তূপীকৃত আবর্জনায় দিনে অন্তত দশ ঘণ্টা ডুবে থেকে রোজগার করেন প্রায় সাড়ে ছ-শো টাকা।
ওই সব এলাকার বিভিন্ন প্লাস্টিকের আড়তে খোঁজ নিয়ে দেখা গিয়েছে, সাধারণ মুদির দোকানে যে ধরনের পলিব্যাগের প্রচলন রয়েছে বাতিল হয়ে যাওয়ার পরে তার বাজার দর কেজি প্রতি ২.৭৫ টাকা থেকে ৩ টাকা। দুধের প্যাকেট, জুতো কিংবা কাপড়ের দোকানে যে ধরনের পলিথিনের ব্যাগ দেওয়া হয় তার দাম কেজি প্রতি ৬ থেকে ৭ টাকা। আরও একটু পুরু মাইক্রনের পলিব্যাগ ৮ টাকা কেজি দরেও বিক্রি করে থাকেন তাঁরা। কেজি প্রতি কাঁচের বোতল এবং বাতিল লোহালক্করেরও দাম রয়েছে যথেষ্ট।
বাড়তি আয়ের খোঁজে তাই অনেক সময়ে পরিবারের সকলেই সকাল থেকে নেমে পড়েন এই কাজে।
আর দিনান্তে বয়ে আনেন বিভিন্ন রোগের বীজ। সরকারি ওই সমীক্ষা বলছে—আবর্জনা কুড়ানোর ফলে অনেকেই বিভিন্ন মারণ রোগের শিকার। যাদের অধিকাংশই নিতান্ত কিশোর কিংবা বালিকা। চর্ম রোগ থেকে শ্বাসকষ্টজনিত রোগের আঁতুরঘর হয়ে রয়েছে চাঁপদানি, কোন্নগরের আবর্জনা-জীবীদের বস্তিগুলি। অনেক সময়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনারও শিকার হচ্ছে এই নাবালকেরা। প্রবল দুর্গন্ধের আবহে দিনের অধিকাংশ সময় কাটানোর ফলে অনেকেই হারিয়ে ফেলেছে ঘ্রাণ-ক্ষমতা। কেউ বা বর্জ্য নিঃসৃত গ্যাসে হারাচ্ছে দৃষ্টি শক্তি।
রঞ্জিতবাবু জানান, আবর্জনা-নির্ভর ওই পরিবারগুলির মধ্যে সচেতনতা ফেরানোর উদ্যোগ ইতিমধ্যেই নিয়েছেন তাঁরা। অসুস্থদের চিকিৎসার পাশাপাশি কম বয়সীদের স্কুলে পাঠানোর উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সাড়া মিলেছে কি?
উত্তরটা দিচ্ছেন আয়েশার মা সালমা, ‘‘আবর্জনা ঘেঁটে দিনে ৪০০ টাকা আয় করে মেয়ে। স্কুলে পাঠিয়ে সেই আয় হারাবো, আমরা কি বোকা?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy