রাজ্যে বিধানসভা ভোট হওয়ার কথা আগামী বছরের মাঝামাঝি। রীতি মানলে এটা এ দফায় অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। এবং সেই বাজেটে আমজনতার মন পাওয়ার চেষ্টায় কসুর করেননি অর্থমন্ত্রী। এক দিকে যেমন নতুন করের বোঝা চাপাননি, তেমন অন্য দিকে কন্যাশ্রীর বৃত্তি বাড়িয়ে, আরও ৪০ লক্ষ পড়ুয়াকে সাইকেল দেওয়ার মতো একগুচ্ছ জনমোহিনী প্রকল্প ঘোষণা করে ‘কল্পতরু’ হতে চেয়েছেন তিনি। যা দেখে বিরোধীদের কটাক্ষ, আগামী বছরের ভোটের কথা মাথায় রেখেই বাজেট ঘোষণা করেছেন অমিতবাবু।
শুধু বিরোধী দলগুলিই নয়, শাসক দলের অন্দরেও গুঞ্জন, এই বাজেট ভোটমুখীই। কারণ, সারদা কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে দলের মধ্যে মুকুল-বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে যথেষ্ট বিব্রত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার। এই অবস্থায় বনগাঁ ও কৃষ্ণগঞ্জের উপ-নির্বাচনের ফল বজায় রেখে কলকাতা-সহ ৯৪টি পুরসভার ভোটে শাসক দলের জয়যাত্রা অটুট থাকলে ভোট এগিয়েও আনতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী। সে কথা মাথায় রেখেই রাজ্যের শিল্প, পরিকাঠামোর উন্নয়নের দিশা না দেখিয়ে পুরোদস্তুর ভোটমুখী বাজেট শুক্রবার বিধানসভায় পেশ করেছেন অমিতবাবু।
তাই, বাজেট বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি একাধিক বার নিজেদের তিন বছরের সঙ্গে বাম আমলের ৩৪ বছরের তুলনা টেনেছেন। নানা সামাজিক প্রকল্প ঘোষণা করতে গিয়ে ‘রেকর্ড’-এর কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন বার বার।
অমিতবাবুর বাজেটে এ দিন তাই বেশির ভাগ প্রকল্পই রয়েছে গ্রাম-বাংলা এবং শহুরে মধ্যবিত্তের ভোট আদায়ের কথা মাথায় রেখে। মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, গত সাড়ে তিন বছরের সরকারে ভোটের বাক্সে মানুষকে টেনে আনতে সব চেয়ে বেশি সফল কন্যাশ্রী প্রকল্প। এ দিনের বাজেট প্রস্তাবে ওই প্রকল্পে তাই বার্ষিক বৃত্তির পরিমাণ ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫০ টাকা করার কথা বলা হয়েছে। বাম আমলে পড়ুয়াদের সাইকেল দেওয়ার কথা প্রথম ঘোষণা হলেও তার ‘ডিভিডেন্ড’ সব চেয়ে বেশি পেয়েছে তৃণমূলই। এ দিনের বাজেট প্রস্তাবে তাই নতুন আরও ৪০ লক্ষ পড়ুয়াকে ওই প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে। যা নিয়ে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সুর্যকান্ত মিশ্রের তির্যক মন্তব্য, “বাজেটে ৪০ লক্ষ সাইকেল দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এত সাইকেল কোথায় পাবেন, জানি না! নতুন সাইকেল শিল্প গড়তে হবে! সাত মন ঘি-ও পুড়বে না, রাধাও নাচবে না!”
শিল্পের রাজ্যের হাল আঁধারেই, নতুন বিনিয়োগের কোনও দিশা নেই। কর্মসংস্থানের নতুন পথও খুলছে না। এই অবস্থায় রাজ্যের যুব সম্প্রদায়ের বড় অংশই ব্যবসায়ে মনঃসংযোগ করছে। মধ্যবিত্ত ওই সব ব্যবসায়ীর কথা মাথায় রেখে ভ্যাটে বড়সড় ছাড় দেওয়ার কথাও ঘোষণা করা হয়েছে। ছোট ও প্রান্তিক চাষিদের জন্য ১০ লক্ষ পাম্প বসানো এবং তাতে ১০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে বাজেট প্রস্তাবে। কিন্তু এত বিপুল পরিমাণ পাম্প বসানো হলে ভূগর্ভস্থ জলে টান পড়বে বলেই মনে করছেন রাজ্যের বিরোধী দলগুলি। সূর্যবাবুর প্রশ্ন, “এত টিউবওয়েল বসানোর ছাড়পত্র কে দেবে? আর ছাড়পত্র ছাড়া বসালে অর্থনীতির মতোই ভূগর্ভস্থ জলেরও তো বারোটা বাজবে!”
ভোটের কথা মাথায় রেখেই ফলাও করে বাজেটে ঘোষণা করা হয়েছে অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য ‘সামাজিক মুক্তি কার্ড’, পরিবহণ কর্মীদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা প্যাকেজের কথা। রয়েছে চা-শ্রমিক এবং চা-বাগানের জন্যও একাধিক কর ছাড়ের প্রস্তাব।
কিন্তু ভোটের কথা মাথায় রেখে অর্থমন্ত্রী কল্পতরু হলে কী হবে, বাস্তবে জনগণের কাছে সেই সুযোগ পৌঁছচ্ছে না বলেই দাবি করেছেন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা। বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য রাজ্য বাজেটকে কল্পনানির্ভর বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “বাজেটের ছত্রে ছত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই!” এই বাজেটকে দিশাহীন বলে দাবি করে কংগ্রেস পরিষদীয় দলের নেতা মহম্মদ সোহরাব বলেন, “পরিসংখ্যান দিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। অনেক মনমোহিনী প্রকল্পের কথা বলা হলেও সেগুলি কার্যকর করার দিশা দেখতে পেলাম না।”
বিরোধী দলগুলির নেতাদের দাবি, অমিত মিত্রের বাজেট বক্তৃতা আক্ষরিক অর্থেই নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা। কিন্তু বাস্তবে জনগণের কাছে উন্নয়নের সুফল পৌঁছচ্ছে না বলেই তাঁদের দাবি। উদাহরণ দিয়ে তাঁরা বলছেন, সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে তাঁদের সরকার রেকর্ড করেছেন বলে বার বার দাবি করেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু সরকারের হিসেবই বলছে ২০১৪-১৫ আর্থিক বছরে বরাদ্দ অর্থ খরচই করতে পারেনি ওই দফতর। একই অবস্থা স্কুলশিক্ষা দফতরেরও। ৬৮৮৪.৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও খরচ হয়েছে মাত্র ৪০৫৭.৬৬ কোটি টাকা। এমনকী, জঙ্গলমহলের জন্য পৃথক ভাবে সরকার কোনও বরাদ্দই করেনি বলে দাবি করেছেন সূর্যবাবু। বাজেটে পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের কোনও উল্লেখ কেন নেই, সে প্রশ্ন তুলে সূর্যবাবু বলেন, “তার মানে এ বছর ওই দফতরে কোনও বরাদ্দই নেই!”
এর মধ্যেও অবশ্য মেলা-খেলা উৎসবে বরাদ্দে খামতি দেওয়া হয়নি। ভোট জোগাড়ে শাসক দলকে সব চেয়ে বেশি সাহায্য করে ক্লাবকে অনুদান। সে কথা মাথায় রেখে এ বারেও প্রায় ৫০ কোটি বাড়ানো হয়েছে। গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তথ্য ও সংস্কৃতি, যুবকল্যাণ এবং পর্যটনের বরাদ্দেও। এমনকী, উৎসবের কথা মাথায় রেখেই বিনোদন করে ঢালাও ছাড় দিয়েছে সরকার। আগে ৬০ টাকা পর্যন্ত টিকিটের মূল্যে কর ছাড় দেওয়া হতো। এখন সেই সীমা বাড়িয়ে ১০০ টাকা করা হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy