Advertisement
E-Paper

সাগর-নদীর জলে মিলিয়ে যাচ্ছে দ্বীপ, সুন্দরবনের ভবিতব্য কি এটাই?

জল দখল করে নিচ্ছে জীবন। রোজ, একটু একটু করে। আর সেই ভয়ই ঘোড়ার মতো ছুটে বেড়ায় গোটা দ্বীপে। জোয়ারের জলে ভয়। ভাটাতেও ভয়ে কাঁটা সকলে। আজ কার ভিটে গেল? কার পানের বরজ ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীর জলে? কোন ধানের খেত উপড়ে নিল জমিখেকো নদী? গোটা দ্বীপের চোখে তাই ঘুম নেই। আশঙ্কায় জেগে থাকে রাত-দিন।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৬ ১৫:৫২
এ ভাবেই জেগে আছে ঘোড়ামারা।

এ ভাবেই জেগে আছে ঘোড়ামারা।

জল দখল করে নিচ্ছে জীবন। রোজ, একটু একটু করে।

আর সেই ভয়ই ঘোড়ার মতো ছুটে বেড়ায় গোটা দ্বীপে। জোয়ারের জলে ভয়। ভাটাতেও ভয়ে কাঁটা সকলে। আজ কার ভিটে গেল? কার পানের বরজ ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীর জলে? কোন ধানের খেত উপড়ে নিল জমিখেকো নদী? গোটা দ্বীপের চোখে তাই ঘুম নেই। আশঙ্কায় জেগে থাকে রাত-দিন। ছোটরা রোজ বার কয়েক করে দেখে আসে কতটা এগিয়ে এল মুড়িগঙ্গা। বড়দের কপালে চিন্তার ভাঁজ আরও বাড়ে।

ঘোড়ামারার কপালেও লোহাচরার নিয়তি
নদীর তাড়া খেতে খেতে এক বার দু’বার নয়, মোট ছ’বার ঘর পাল্টেছেন শেখ হোসেন। প্রথম পাঁচটি এখন নদীর পেটে। সেখান দিয়ে এখন পারাদ্বীপ, কলকাতা, হলদিয়া বন্দরমুখী জাহাজ চলে। ষষ্ঠ ভিটের দাওয়ায় বসে শেখ হোসেন শোনাচ্ছিলে‌ন তাঁর ভাঙন-কাহিনি। ‘‘ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি, নদী প্রতি দিন গিলে খেতে আসে। বাপ-দাদার ভিটে জলে চলে যাওয়ার আগেই আর একটু উঁচুতে আমরা ঘর বেঁধেছিলাম। তখন জোয়ান বয়স। তার পর এক এক করে পাঁচটা ঘর খেয়ে ফেলেছে নদী। এখন যেখানে বসে আছি, এটাও যে কোনও দিন চলে যাবে!’’ চোখের কোণা চিক চিক করে ওঠে বৃদ্ধের।

প্রতি দিন জোয়ারের জল ঢুকে আসে দ্বীপের ভিতর। আগে স্লুইস গেট দিয়ে সেই জল বের করে দেওয়া যেত। কিন্তু, এক বার জলের তোড়ে সেই গেট গেল ভেঙে। তার পর থেকে আর জল বেরোয় না। দ্বীপের কচ্ছপের পিঠের মতো অংশেও এখন নদীর জল। আর দ্বীপের পাড় তো রোজই ভাঙছে। শুধু পাড় নয়, পাড়ের সঙ্গে অনেকটা করে জমি-জিরেত-ভিটেও। জোয়ান বয়স থেকে এই ভাঙন দেখতে দেখতে তিনি নিশ্চিত, ঘোড়ামারার কপালেও লোহাচরার নিয়তি লেখা হয়ে গিয়েছে। একা শেখ হোসেন নন, এমন বিশ্বাস শিকড় গেড়ে বসেছে দ্বীপের প্রায় সকলের মধ্যেই। স্বপন পুরকাইতের চারখানা পানের বরজ ছিল। সব ক’টি নদী খেয়ে নিয়েছে। বর্তমানে দিনমজুরের কাজ করা স্বপনবাবু বললেন, ‘‘খাসিমারার দিকে আমার চারটে পানের বরজ ছিল। এখন একটাও নেই। সব নদীর পেটে। অপেক্ষায় আছি, কবে ভিটেটাও চলে যায়!’’

কয়েক বছরের মধ্যেই সব ধুয়ে-মুছে যাবে
সুন্দরবনের মানচিত্র থেকে আর একটা আস্ত দ্বীপ হয়তো কয়েক বছরের মধ্যেই ধুয়ে-মুছে যাবে নদীর জলে! অথচ সাগর ব্লকের ওই ঘোড়ামারা দ্বীপে আছে প্রায় বারোশো পরিবারের বাস। আছেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার ভোটার। আছে প্রাইমারি স্কুল। হাইস্কুল। পঞ্চায়েত অফিস। পোস্ট অফিস। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। সুফলা চাষের জমি। একটা সচ্ছল জনপদে যা যা থাকে— তার সবই আছে। কিন্তু, দ্বীপের আয়তন ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে! রোজই নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে তার সম্পদ।

সাগর দ্বীপের উত্তরে এই ঘোড়ামারা। আর দুই দ্বীপের মাঝে ছিল আরও একটা দ্বীপ, তার নাম লোহাচরা। নদী তাকে আস্ত গিলে খেয়েছিল। এখন একই আশঙ্কায় প্রহর গোনে ঘোড়ামারা। ভাটায় মুড়িগঙ্গার প্রবল স্রোত এবং জোয়ারে সমুদ্রের ঢেউ— এই দুয়ের কবলে দীর্ঘ দিন ধরেই ভাঙনকাল চলছে এখানে। প্রশাসনের হিসেবে ১৩০ বর্গকিলোমিটার থেকে এখন ক্ষয়ে ক্ষয়ে দ্বীপের আয়তন দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৫ বর্গকিলোমিটারে। যার ১৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা আবার উপকূল-সংলগ্ন। ইতিমধ্যে অনেকে দ্বীপ ছেড়ে পুনর্বাসন নিয়েছেন অন্যত্র। কেউ পালিয়েছেন আরও দূরে। দ্বীপ ক্রমশ ছোট হয়েছে।

জমিখেকো নদীর কারণে সঙ্কটে ঘোড়ামারা। দেখুন ভিডিও...

সুন্দবনটা আর তেমন করে গড়ছে না
ছোট হতে হতে সে নাকি মিলিয়ে যাবে এক দিন। কয়েক দশক পরে ঘোড়ামারার নাকি কোনও অস্তিত্বই থাকবে না! এমনটাই জানালেন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচারের অনুরাগ দণ্ড। তাঁর কথায়, ‘‘আগামী ৫০ বছরের মধ্যে ঘোড়ামারার কোনও অস্বিস্ত যে থাকবে না, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।’’ শুধু ঘোড়ামারাই নয়, গোটা সুন্দরবনের চেহারাও নাকি আর এমনটা থাকবে না, দাবি করলেন তিনি।

কিন্তু, কেন?

অনুরাগবাবুর ব্যাখ্যা, উষ্ণায়নের জন্য জলের আয়ত‌ন বেড়েছে। ফলে, সে বেশি জায়গা নিচ্ছে। সুন্দরবন তো ব-দ্বীপ অঞ্চল। এত বছর ধরে সে পলি দিয়ে গড়ে উঠেছে। ব-দ্বীপের মূল গঠনতন্ত্র তো পলিকে কেন্দ্র করে। তাঁর মতে, সেই পলির জোগান নাকি আর নেই! পলির মূল জোগান আসত গঙ্গা, ভাগীরথী, হুগলি নদী দিয়ে। কিন্তু, ফরাক্কা বাঁধ তাতে বড় আঘাত হেনেছে। শুধু এ রাজ্যে নয়, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, এমনকী উত্তরাখণ্ডেও নদীকে আটকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। অনুরাগবাবু বলেন, ‘‘বাঁধ থেকে শুরু করে নানা রকমের সেচ প্রকল্প তৈরি করে আমরা নদীর জল তো সরিয়েইছি, পাশাপাশি পলিটাও সরিয়ে নিয়েছি। সুতরাং আমাদের দিকে সুন্দবনটা আর তেমন করে গড়ছে না।’’

তবে পলি যে আসছে না, এই দাবির উল্টো মতও আছে। সেই অংশের প্রশ্ন, পলি না আসলে ঘোড়ামারার পাশে নতুন চর জাগছে কী করে? বা নয়াচর আয়তনে বাড়ছেও বা কী করে দিন দিন? পাশাপাশি নদী থেকে পলি তুলতে তো সাগরমেলার সময় প্রশাসন থেকে প্রতি বছর ড্রেজিংও করা হয়। পলি না এলে, এ সব সম্ভব কী ভাবে?


মুড়িগঙ্গার পাড়ে ঘোড়ামারা

আগে সুন্দর ধান হত। বড় বড় পানও। আর এই দুয়ের জন্যই বিখ্যাত ছিল ঘোড়ামারা, খাসিমারা এবং লোহাচর। এখন সে সব দিন নেই। পড়ে আছে শুধু ঘোরামারা। প্রতি দিন জমি জলে যাওয়ায় ধান উত্পাদন প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। সে সব দিনের কথা বলছিলেন সঞ্জীব সাগর। তাঁর কথায়, ‘‘ধান-পানকে নিয়েই একটা জনপদের সমৃদ্ধি ছিল। এখন সেই সব অতীত। চাষের কথা কেউ ভাবে না। সকলে এখান থেকে পালানোর কথা ভাবে।’’ ঘোড়ামারা থাকবে না, সেটা বিশ্বাস করতেন ছোটবেলা থেকে। কিন্তু এত দ্রুত যে তা পাল্টে যাবে, এটা ভাবেননি সঞ্জীববাবুরা।

সাগর এগিয়ে এসে ধীরে ধীরে সুন্দরবনের ভূমি যে গ্রাস করছে
‘‘ঘোড়ামারা পাল্টাচ্ছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।’’— বললেন নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র। তাঁর দাবি, অতীতে ঘোড়ামারা সাগর দ্বীপের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। পরে এটি বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি আলাদা দ্বীপের চেহারা নেয়। এবং ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হতে শুরু করে।

তবে কি আগামী কয়েক দশকে ঘোড়ামারা-সহ গোটা সুন্দরবনের অস্তিত্ব হারিয়ে যাবে?

কল্যাণবাবুর দাবি, সুন্দরবনের উপকূল এলাকা বদলাচ্ছে। যেমন, ঘোড়ামারা, মৌসুমী-সহ বেশ কয়েকটি দ্বীপ ক্ষয়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে, নয়াচরের আয়তন বাড়ছে। তাঁর কথায়, ‘‘সুন্দরবন এলাকায় গত ১০০ বছরে প্রায় ৪০০ বর্গ কিলোমিটার ভূমি ক্ষয়ে গিয়েছে। সাগর দ্বীপের কাছে সমুদ্র গত আড়াইশো বছরে প্রায় ১২ কিলোমিটার এগিয়ে এসেছে। সাগর এগিয়ে এসে ধীরে ধীরে সুন্দরবনের ভূমি যে গ্রাস করছে এ কথা সত্যি। তবে, আগামী কয়েক দশকেই গোটাটা বিলুপ্ত হয়ে যাবে, এমনটা নয়।’’


জল বাড়ছে সাগরের
কেন এগিয়ে আসছে সমুদ্র?

কারণ, সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে। আর এ জন্য বিশ্ব উষ্ণায়নকেই দায়ী করছেন সমুদ্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক সুগত হাজরা। তাঁর মতে, সমুদ্রপৃষ্ঠের পাশাপাশি এই এলাকার বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বছরে ০.০১৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড করে বাড়ছে। হিসেব কষলে দেখা যাবে, ৫০ বছরে প্রায় ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বাড়বে। তিনি বলেন, ‘‘সুন্দরবন এবং সংলগ্ন এলাকায় সমুদ্রের জলস্তরও বাড়ছে দ্রুত হারে। বছরপ্রতি প্রায় ৩.১৪ মিলিমিটার। বিশ্বের অন্যান্য জায়গার গড় জলবৃদ্ধির থেকে যা অনেক বেশি।’’

ভাঙন রুখতে ভেটিভার
তবে, উপায়?

ঘোড়ামারার ভাঙন ঠেকাতে নানাবিধ প্রকল্প হাতে নিয়েছিল সরকার। কখনও গাছ বসিয়ে, কখনও খাঁচা লাগিয়ে ভূমিক্ষয় আটকানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু, কাজে দেয়নি কিছুই। সম্প্রতি ক্ষয়িষ্ণু এই দ্বীপে বিশেষ ধরনের এক ঘাস ‘ভেটিভার’ লাগিয়ে মাটি ক্ষয় রোধের চেষ্টায় নেমেছে প্রশাসন। দক্ষিণ ভারত থেকে আনা এই ঘাস স্থানীয় পঞ্চায়েতের মাধ্যমে লাগানোও হয়েছে। প্রশাসনের দাবি, ভেটিভার মাটির উপরে চার-পাঁচ ফুট পর্যন্ত বাড়ে। মাটির তলায় ১২-১৫ ফুট পর্যন্ত খুবই শক্তিশালী ভাবে তা শিকড় চারায়। মাটিকে আঁকড়ে রাখে। এর আগে বোল্ডার, রিং বাঁধ— সব কিছুই মুড়ি গঙ্গার প্রবল স্রোতে খড়কুটোর মতো ভেসে গিয়েছে। এখন ভরসা ভেটিভার।


নদীর এগিয়ে আসা ঠেকানোর কাজ চলছে ঘোড়ামারায়।

মৃত্যু বোধহয় আর এখানে হবে না
কিন্তু, তাতেও চিন্তা ঘোচে না । জীবনের সন্ধানে থাকা দ্বীপবাসীর কাছে জলই এখন ‘মরণ’-এর কারণ। বিশ্ব জুড়ে ভীষণ প্রচলিত শব্দটা যে তাঁদের গায়ে আর কিছু দিনের মধ্যেই সেঁটে যাবে, সে ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত— পরিবেশ উদ্বাস্তু। শিকড় সমেত দ্বীপটাকেই যে উপড়ে নিতে চায় জীবনখেকো নদী! আর পরিবেশের সেই প্রাকৃতিক চাওয়ার কাছে বড়ই অসহায় যে তাঁরা!

তাই শেখ হোসেনরা দিন গোনেন। আর ক’দিন জেগে থাকবে তাঁদের ভিটে-মাটি-ঘর! চিকচিকে চোখে শেখ হোসেন বললেন, ‘‘জন্ম থেকেই এই দ্বীপে। মৃত্যু বোধহয় আর এখানে হবে না। তার আগেই হয়তো সব টেনে নিয়ে যাবে নদী।’’

প্রতিবেদন সম্পাদনা: উজ্জ্বল চক্রবর্তী
গ্রাফিক্স: সোমনাথ মিত্র
ছবি এবং ভিডিও: অজয় রায়

ঘোড়ামারার আরও ছবি দেখতে নীচে ক্লিক করুন...

Ghoaramara Sunderban Erosion
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy