মহিলা আধিকারিকের নামে দুর্নীতির অভিযোগ, তদন্তকারীদের বিরুদ্ধে হেনস্থার পাল্টা নালিশ, থানা-পুলিশ, শো-কজ। শেষে অসুস্থতার কারণে মহিলার অনুপস্থিতি।
আপাতত এই নিয়েই সরগরম রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম, বঙ্গে শিল্পায়নের চাকা গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার গুরু দায়িত্ব যাদের কাঁধে! ঘটনাটিকে ঘিরে প্রায় আড়াআড়ি ভাগও হয়ে গিয়েছে নিগমের অন্দরমহল!
সিঙ্গুর-মামলায় এক আইনি উপদেষ্টা সংস্থাকে মোটা টাকা পাইয়ে দিয়ে ‘ঘুষ’ নিয়েছেন— এই অভিযোগে নিগম-কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট মহিলা অফিসারের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছিলেন। মহিলা থানায় পাল্টা লিখিত নালিশ জানান, তদন্তের নামে নিগমের শীর্ষ কিছু পদাধিকারী তাঁকে হেনস্থা ও মানসিক নির্যাতন করেছেন। দাবি ভিত্তিহীন বলে পুলিশ জানিয়ে দিতেই কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি তাঁকে ‘শো-কজ’ করেছেন, অন্য এক ঘটনায়।
মহিলা হলেন নিগমের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (আইন) মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, অসুস্থতার জন্য এখন যিনি অফিস যাচ্ছেন না। তদন্ত কমিটির যে তিন সদস্যের দিকে ওঁর আঙুল, তাঁরা হলেন নিগমের জেনারেল ম্যানেজার অজয়কুমার পাণ্ডে এবং দুই উপদেষ্টা— সোমনাথ মুখোপাধ্যায় ও বিপ্লব শূর। বিপ্লববাবু সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন।
রাজ্যে লগ্নি আকর্ষণে যে সংস্থা সরকারের প্রধান ভরসা, সেখানে সব কিছু ছাপিয়ে এই ঘটনাটাই সকলের মুখে মুখে। নবান্ন-সূত্রের খবর: পত্তন হওয়া ইস্তক শিল্পোন্নয়ন নিগমের উঁচুতলায় এ হেন কাদা ছোড়াছুড়ি দেখা যায়নি। জুডিশিয়াল সার্ভিস ছেড়ে এসে এক দশকের বেশি সময় ধরে নিগমে কাজ করছেন মীনাক্ষীদেবী। নিচুতলার কর্মী-অফিসারদের বড় অংশ তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়েছেন।
নিগমের কর্তৃপক্ষ বা ঘটনার চরিত্রেরা অবশ্য মুখ খুলতে নারাজ। তদন্ত কমিটির প্রধান অজয় পাণ্ডে বলেন, ‘‘এ নিয়ে কথা বলার অধিকার আমার নেই।’’ অন্য দুই সদস্যও মন্তব্য করতে চাননি। মীনাক্ষীদেবী জানিয়েছেন, অফিসের ব্যাপারে বাইরে কিছু বলবেন না। নিগমের এমডি কৃষ্ণ গুপ্তের সঙ্গে ফোন-এসএমএসে যোগাযোগের চেষ্টা করে সাড়া মেলেনি। নিগমের চেয়ারম্যান তথা রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্রকেও ফোন বা এসএমএস করে উত্তর পাওয়া যায়নি।
দ্বন্দ্বের সূত্রপাত কী ভাবে?
নিগম-সূত্রের খবর: সিঙ্গুর সংক্রান্ত এক গুচ্ছ মামলার সুবাদে নিগমকে কয়েক কোটি টাকা বিল মেটাতে হয়েছিল। তখন এর দায়িত্বে ছিলেন মীনাক্ষীদেবী। অভিযোগ ওঠে, ২০১২-য় এক আইনি পরামর্শদাতা সংস্থাকে মোটা বিল ‘পাইয়ে দেওয়ার’ বিনিময়ে তিনি ঘুষ নিয়েছেন। আটকে যায় তাঁর পদোন্নতি। বিস্তর টানাপড়েন শেষে গত মাসে এমডি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গড়েন। তারা এপ্রিলে মীনাক্ষীদেবীকে বিভাগীয় তদন্তের জন্য তলব করেছিল। মীনাক্ষীদেবীর দাবি, কমিটির সামনে হাজির হলে তাঁকে সন্ধে থেকে রাত প্রায় এগারোটা পর্যন্ত কার্যত আটকে রাখা হয়, এমনকীঅসুস্থ বোধ করলেও ছাড়া হয়নি! তিন তদন্তকারীর বিরুদ্ধে শেক্সপিয়র সরণি থানায় লিখিত নালিশ দায়ের করে মীনাক্ষীদেবী জানান, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রেখে ওঁরা তাঁকে হেনস্থা ও মানসিক পীড়ন করেছেন।
পুলিশ পরে মীনাক্ষীদেবীকে চিঠিতে জানিয়ে দিয়েছে, তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে কোনও মামলা রুজু করা যায় না। এবং অভিযোগ, পুলিশে যাওয়ার ‘শাস্তি’ হিসেবে পুরনো একটি ঘটনাকে সামনে এনে ফের তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করেছেন কর্তৃপক্ষ। সেটা কী রকম?
নিগমের ভিতরের খবর, খড়গপুরের কৌশল্যায় তাদের ১৩ একর জমি একটি অটোমোবাইল সংস্থাকে দেওয়া হয়েছিল বেশ ক’বছর আগে। সেই জমি দেখিয়ে সংস্থাটি ব্যাঙ্ক-ঋণ নিয়েছিল। ঋণ শোধ না-হওয়ায় ব্যাঙ্ক ‘বন্ধকী জমি’টি অন্য সংস্থাকে ‘লিজ’ দেয়, যাতে নিগমের লোকসান হয়েছে অন্তত দু’কোটি টাকা। যে হেতু এটাও মীনাক্ষীদেবী দেখাশোনা করেছেন, তাই এ বার তাঁকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে।
পুরো বৃত্তান্তে ‘অন্য গন্ধ’ও পাচ্ছেন নিগমের একাংশ। তাঁরা বলছেন, প্রতিষ্ঠানের কারও কারও নামে হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যাল্স সংক্রান্ত মামলার ‘বিল পেমেন্ট’ নিয়ে উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। ‘‘ওঁদের বেলা কর্তৃপক্ষ নীরব কেন?’’— প্রশ্ন এই মহলের। কিছু অংশের দাবি, মীনাক্ষীদেবী রাজ্যের প্রাক্তন এক সিপিএম মন্ত্রীর আত্মীয়া বলেই ওঁকে সরাতে উঠে-পড়ে লেগেছেন অনেকে।
যা-ই হোক না কেন, ঘটনাটি অভূতপূর্ব। আর তা নিয়েই আপাতত তোলপাড় রাজ্যে শিল্পায়নের যজ্ঞাগার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy