জুম্মার নমাজ তখন সবে শেষ হয়েছে। সাদা কুর্তা-পাজামাধারী জমায়েতটা রাজাবাজারের রাস্তার দু’ধারে সারিবদ্ধ। হাতে হাতে কয়েকটা তেরঙা পতাকা নিয়ে বুকের কাছে মেলে ধরছেন ওঁরা। কেউ বা পোস্টার উঁচিয়ে ধরেছেন! তাতে বড় হরফে লেখা, ‘টেররিজ়ম হ্যাজ় নো প্লেস ইন ইসলাম’ (ইসলামে সন্ত্রাসের ঠাঁই নেই)! যা দেখে মোটরবাইক আরোহী পথচলতি ব্যক্তি থমকে দাঁড়ালেন। পরিচয় দিলেন, তাঁর নাম নমন সিংহ! বললেন, “আমি আপনাদের সঙ্গে দাঁড়াতে পারি?” সমস্বরে শোনা গেল, ‘‘কেন নয়?’’ কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়ানো জনতার মাঝে আরও একটি অবয়ব মিশে গেল। প্রত্যক্ষদর্শীরা দেখেছেন, নমন সিংহের মোটরবাইকে ‘জয় হিন্দু’ লেখা ছিল।
নারকেলডাঙার পূর্ব কলকাতা সর্বজনীন পুজোর কর্মকর্তা মানসরঞ্জন দত্ত বলছিলেন, “রাজাবাজারের লোকজন জঙ্গি হামলায় নিহতদের মুখগুলির ছবি ছাপিয়ে এনেছিল। তা হাতে ছিল অনেকেরই।” রাজাবাজারের হিউম্যান কেয়ার বলে একটি মানবাধিকার মঞ্চের জাভেদ আলম, উমর আওয়েজ প্রমুখ এই জমায়েতের ডাক দেন। জাভেদ বলছিলেন, “ইদানীং জুম্মার নমাজের পরে অনেকে ওয়াকফ নিয়ে কথা বলতেন। তাঁরাই পহেলগাম নিয়ে পথে নামার কথা বলছিলেন।’’
প্রতিবাদের আবহে মিশে গিয়েছে রাজাবাজার, পার্ক সার্কাস, মেটিয়াবুরুজ থেকে গোটা রাজ্য। শুক্রবার দুপুরে উলুবেড়িয়ার জাম-ই মসজিদ থেকে একটি মৌন মিছিল মহকুমাশাসকের কার্যালয়ের সামনে এসে শেষ হয়। যুবকদের হাতে ছিল জাতীয় পতাকা ও সম্প্রীতির পোস্টার। হুগলির ইমামবড়ায় জুম্মার নমাজে জঙ্গি হামলার নিন্দা করে শান্তির আহ্বান জানানো হয়। বোলপুরের সব মসজিদেও নিহতদের জন্য শোকের শরিক হয়ে অনেকে জড়ো হন। বোলপুর টাউন মসজিদের সভাপতি মুর্শিদ নওয়াজ খান বলেন, ‘‘ইসলাম অহেতুক হিংসা সমর্থন করে না।”
কলকাতার নারকেলডাঙার জামা মসজিদের ইমাম মাকারিম আহসান করিমের বক্তৃতা দুপুরের নমাজ শুরুর আগে মন দিয়ে শুনছিলেন অনেকেই। ইমাম সাহেব বলছিলেন, “নির্দোষ নিরপরাধের হত্যা ইসলামের শিক্ষা নয়। এক জন নিরপরাধকে মারাটাও সমগ্র ইনসানিয়াতের (মানবতা) উপরে আঘাত। ইসলাম তো অকারণে একটি পাখি মারা বা ছায়া বিছানো গাছ কাটাও সমর্থন করে না।” গম্ভীর মুখে শুনছিলেন অনেকে। ব্রাইট স্ট্রিটের বাসিন্দা ডাক্তার শাহরিয়র সেলিমের কথায়, “পার্ক সার্কাস এলাকায় অনেক মসজিদের ইমাম সাহেব এবং মসজিদ কমিটিই শুক্রবারের দুপুরটা নিজেরা প্রতিবাদের জন্য বেছে নিয়েছিলেন।” রিপন স্ট্রিটের কাছে তাঁতিবাগান আহলে হাদিস মসজিদ বা পার্ক সার্কাস সাত মাথার মোড়ে ভবন চৌধুরী মসজিদের সামনেও মানববন্ধন হয়েছে। তপসিয়ার বিলাল মসজিদ, বাঁশবাগান মসজিদেও ইমামদের উপদেশে পহেলগামের বিপর্যয়ের শোক সামলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সঙ্কল্প উঠে আসে। দুঃসময়ে একমাত্র বেঁধে বেঁধে থাকাই রাস্তা, লিখেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। জুম্মার দুপুরে হিন্দু-মুসলিমের সংহতি, সমাজমাধ্যমের বিদ্বেষের ছবি ঘোর মিথ্যে করে তুলল।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)