এমনিতেই বছরে গড়ে প্রায় দেড়শো দিন বন্ধ থাকে কলকাতা হাইকোর্ট। তার উপরে প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর না চাইলেও কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীরা আচমকাই কর্মবিরতি পালন করছেন বা ছুটি নিচ্ছেন। হাইকোর্টে সরকার পক্ষের আইনজীবীরাও অনেক সময় আদালতে উপস্থিত না থাকায় প্রধান বিচারপতিকে প্রায়ই প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করতে হচ্ছে। শ্রীরামপুর আদালতেও সম্প্রতি আইনজীবীরা একটি এজলাসের কাজ টানা ৫০ দিন বন্ধ করে রেখেছিলেন। এ সবের ফলে চূড়ান্ত ভোগান্তি হচ্ছে বিচারপ্রার্থীদের। এই পরিস্থিতিতে আইনজীবীর সওয়াল ছাড়াই কোনও ভাবে মামলার নিষ্পত্তি করা যায় কি না, সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এমনকী আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের ধাঁচে শুধু নথি দেখেই রায় ঘোষণা করা যায় কি না, সেই ভাবনাও উঁকি মারছে। যাঁকে সমর্থন করেছেন একাধিক আইনজীবী। এর উল্টো মতও অবশ্য আছে। হাইকোর্টের একাধিক আইনজীবী মনে করেন, শুনানি ছাড়া শুধু মাত্র নথি দেখে রায় ঘোষণা করা সম্ভব নয়। শুধু নথি দেখে রায় ঘোষণা কতটা সংবিধানসম্মত, সে প্রশ্নও তুলেছেন তাঁরা।
বিতর্ক যা-ই থাক, যে ভাবে দিনের পর দিন আদালতের কাজ বন্ধ থাকে বা ব্যাহত হয়, তাতে ক্ষুব্ধ একাধিক প্রবীণ আইনজীবীই। এই প্রসঙ্গেই কলকাতা হাইকোর্টের প্রবীণ এক আইনজীবী সম্প্রতি ওই আদালতে চলা এক মামলার উদাহরণ টেনে বলেছেন, ওই মামলায় সংশ্লিষ্ট বিচারপতি কোনও পক্ষকেই সওয়াল করার অনুমতি দেননি। মামলার নথি পড়েই তিনি রায় ঘোষণা করেছিলেন। আচমকা আন্দোলনে বা কর্মবিরতির ধাক্কায় যে ভাবে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি হচ্ছে, তাতে ক্ষুব্ধ ওই আইনজীবী বলেন, “আইনজীবীরা এখনও সতর্ক না হলে পরে হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট কেবল নথি দেখেই রায় ঘোষণা
করতে পারে। যে ভাবে শ্রীরামপুর আদালতের আইনজীবীরা এজলাস বয়কট করেছেন কিংবা কলকাতা হাইকোর্টের শতকরা ৮৫ ভাগ আইনজীবী শুক্রবার প্রধান বিচারপতির নির্দেশ অমান্য করে ছুটি ভোগ করেছেন, তাতে নথি দেখে রায় দেওয়ার নির্দেশ হাইকোর্ট দিতেই পারে বলে মনে করছেন অন্য এক প্রবীণ আইনজীবী।
আর এক প্রবীণ আইনজীবী বলেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, বছরে ২১০ দিন হাইকোর্ট খোলা রাখতেই হবে। কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি কিন্তু হোলির ছুটি মঞ্জুর করতে চাননি, এমন নয়। তিনি চেয়েছিলেন, তার পরিবর্তে অন্য একটি ছুটির দিনে হাইকোর্ট খোলা থাকুক। অধিকাংশ আইনজীবী তা মানতে চাইলেন না। সে ক্ষেত্রে কারা বিষয়টি নিয়ে জেদ ধরে বসে রইলেন, সেই প্রশ্নও তুলেছেন ওই প্রবীণ আইনজীবী। তিনি আরও জানান, হাইকোর্টের বিচারপতিদের ক্ষমতা রয়েছে, দিনের পর দিন এক পক্ষের আইনজীবী গরহাজির থাকলে কোনও মামলা একতরফা শুনে রায় দেওয়ার। কিন্তু দু’পক্ষের প্রতি সুবিচার হবে না বলেই বিচারপতিরা তা করেন না।
কলকাতা হাইকোর্টের এক আইনজীবী জানান, আইনজীবীদের গরহাজিরার ঠেলায় এমন ঘটনাও ঘটছে যে বিচারপ্রার্থীরা বিচারপতির এজলাসে এসে জানাচ্ছেন, তিনি নিজেই তাঁর বক্তব্য পেশ করবেন! আইনজীবীরা আদালতে হাজির না থাকায় বিচারপ্রার্থীদের সরাসরি আদালতে চলে আসার প্রবণতা বাড়লে আদতে ক্ষতি কার, সেই প্রশ্নও তুলেছেন ওই আইনজীবী।
সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “আইনজীবীরা না-ই আসতে পারেন। কিন্তু আদালত খোলা থাকলে বিচারপতিরা বিচার করতে পারবেন না, এমন কোথায় লেখা রয়েছে?” বিচারপতিরা বিচারপ্রার্থীদের বক্তব্য শুনে বা মামলায় দু’পক্ষের নথি (বক্তব্য) পড়ে কোনও নির্দেশ দিতেই পারেন।’’ আর এক প্রবীণ আইনজ্ঞ জানান, আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টে অনেক মামলার নিষ্পত্তি হয় কেবল নথি দেখেই। বিচারপ্রার্থীদের স্বার্থে এখানেও তেমন হতেই পারে।
কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আইনজীবীরা হাজির না থাকলে বিচারপতিরা বিচারপ্রার্থীদের বক্তব্য শুনে, নথি দেখে মামলা নিষ্পত্তি করতে পারেন।
অনেক ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীরা তাঁদের বক্তব্য ঠিক মতো পেশ করতে পারেন না। তাই আইনজীবীদের সাহায্য নিতে হয়। তা ছাড়া, এখন সুপ্রিম কোর্টে কিউরেটিভ পিটিশন চালু হয়েছে। রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও দিকে আলোকপাত করা হয়নি বলে মনে করলে বিচারপ্রার্থী সংশ্লিষ্ট বিচাপতির আদালতেই তা সংশোধনের আর্জি জানাতে পারেন। সে ক্ষেত্রে মামলার নথি দেখেই বিচারপতিরা রায় দিতে পারেন।”
তবে নথি দেখে রায় ঘোষণা প্রসঙ্গে আইনজ্ঞদের একাংশের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন হাইকোর্টের আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ ও বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। অরুণাভবাবু বলেন, “দু’পক্ষের নথি যদি গড়ে ১০০ পাতার হয়, তা হলে তা পড়ে দিনে কতগুলো মামলার নিষ্পত্তি করবেন বিচারপতিরা? আইনজীবীরা তাঁদের মক্কেলদের বক্তব্য সহজে ও সংক্ষিপ্ত আকারে পেশ করে বিচারপতিদের সাহায্য করেন। আমাদের দেশে সব বিচারপ্রার্থীর নিজের বক্তব্য সরাসরি পেশ করার ক্ষমতাও নেই।” আর আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, “শুনানি ছাড়া কেবল নথি দেখে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টে অনেক মামলার নিষ্পত্তি হয়, এমনটা ঠিক নয়। তবে ওখানে শুনানির সময় একেবারে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। তাই মামলার নিষ্পত্তিও দ্রুত হয়।” এই দুই আইনজীবীই জানান, কিউরেটিভ পিটিশন কেবল সুপ্রিম কোর্টের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অন্য আদালতে তার সুযোগ নেই।
কলকাতা হাইকোর্টের অধিকাংশ আইনজীবী আবার মনে করেন, শুনানি ছাড়া কেবল নথি দেখেই রায় দিতে পারেন না হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বা অন্য বিচারপতিরা।
কেন? এই আইনজীবীরা জানান, এ দেশের সংবিধান অনুযায়ী বিচারপর্ব প্রকাশ্যে হতে হয় এবং উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে তবেই বিচারপতি রায় দেন। সেই কারণে প্রধান বিচারপতি বা অন্য বিচারপতি বা নিম্ন আদালতের বিচারকদের এজলাসে বিচারপ্রার্থীদের প্রবেশও অবাধ। যদি প্রকাশ্যে ও উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে বিচার করাই সংবিধানসম্মত হয়, তবে কেবল নথি দেখে বিচার করা অসাংবিধানিক হবে বলেই মনে করেন এই আইনজীবীরা।
অরুণাভবাবুর অভিযোগ, হাইকোর্টের বেশ কয়েক জন বিচারপতি সময় মতো এজলাসে ওঠেন না। সে ক্ষেত্রেও আদালতের সময় নষ্ট হয়। মামলার সংখ্যার বিচার করে দশ বছর আগেই বলা হয়েছিল, কলকাতা হাইকোর্টে ৫৯ জন বিচারপতি থাকা প্রয়োজন। এখন প্রয়োজন আরও বেড়েছে। কিন্তু বর্তমানে ৩৭-৩৮ জনের বেশি বিচারপতি কলকাতা হাইকোর্টে নেই বলে জানান তিনি। তার মধ্যেও দু’জন বিচারপতিকে নিয়ম করে -ও আন্দামানে যেতে হয়, বিচার করতে। অরুণাভবাবুর কথায়, “প্রধান বিচারপতির উচিত এই সমস্যার সমাধানেও উদ্যোগী হওয়া।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy