আরামবাগ বাসস্ট্যান্ডে তৃণমূলের তরফে যাত্রীদের গোলাপ দেওয়া হচ্ছে। ছবি: মোহন দাস।
শুক্রবার বেলা ১২টা।
হুগলির আরামবাগের ব্লক ভূমি রাজস্ব দফতর থেকে বেরোচ্ছিলেন বতানল গ্রামের বৃদ্ধ সওকত মোল্লা। তখনই ওই দফতরে ঢুকছিলেন প্রতিবেশি বিভাস মালিক। পড়শিকে দেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘চাচা কাজ মিটল? রেভিনিউ অফিসার আছেন?” বৃদ্ধ সহাস্যে বলে উঠলেন, “এমনি করে প্রতিদিন ধর্মঘট ডাকলেই হয়! আজ দেখো চাঁদের হাট। যাকে খুঁজবে তাকেই পাবে!”
শুধু সওকত মোল্লা একা নয়। ধর্মঘটের সুফল নিয়ে এক রকম চর্চাই শুরু হয়ে গিয়েছে। আরামবাগ মহকুমা খাদ্য দফতর থেকে ফিরে পুরশুড়া, আরামবাগ, খানাকুল প্রভৃতি এলাকার কয়েকজন রেশন ডিলার বলেন, “অফিসারের খোঁজ পেতে জুতোর সুখতলা খয়ে যায়। আজ তো দেখছি সবাই হাজির। কর্মসংস্কৃতি ফেরাতে ধর্মঘটই দেখছি ওষুধ!”
আক্ষরিক অর্থেই মহকুমার সরকারি অফিসগুলিতে এ দিন অফিসার এবং কর্মীদের যাঁকেই খোঁজ করা গিয়েছে, তাঁরই দেখা মিলেছে। ভারপ্রাপ্ত মহাকুমাশাসক দেবজ্যোতি বসু দাবি করেছেন, “মহকুমার সব কটি সরকারি অফিসে কর্মীদের হাজিরা ১০০ শতাংশ।’’ তবে, অনেকেই অভিযোগ করেছেন, সরকারি দফতরে কর্মীরা উপস্থিত থাকলেও কাজ মেটেনি তাঁদের। কেন না, কর্মীদের অধিকাংশই ছিলেন উৎসবের মেজাজে।
মহকুমার প্রায় সব রুটেই বাস চলাচল ছিল স্বাভাবিক। যদিও দূরপাল্লার বাসে যাত্রীসংখ্যা ছিল কম। আরামবাগ শহরের বাজারগুলো এবং রাস্তাও ছিল অন্যদিনের মতোই জমজমাট। সকালে তৃণমূলের পক্ষে আরামবাগ বাসস্ট্যান্ডে এবং বিভিন্ন রাস্তায় বাস থামিয়ে যাত্রীদের ধর্মঘট উপেক্ষা করে বের হওয়ার জন্য গোলাপ ফুল দেওয়া হয়েছে। বামেদের ডাকা এই ধর্মঘটের ফলাফল নিয়ে আরামবাগ সিপিএমের জোনাল সম্পাদক পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ধর্মঘট বিরোধিতা করার নামে সরকারি অফিসগুলিতে উৎসব হচ্ছে।’’ তৃণমূল নেতাদের অবশ্য দাবি, সাধারণ মানুষ ধর্মঘট চান না। পথে বেরিয়েই তাঁরা ধর্মঘটের বিরোধিতা করেছেন।
চুঁচুড়া সদর ব্যসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় সব রুটের বাসই চলেছে। জেলার অন্যান্য প্রান্তেও বাস চলাচল মোটের উপর স্বাভাবিকই ছিল। সকাল থেকেই উত্তরপাড়া, কোন্নগর, শ্রীরামপুর, বৈদ্যবাটির মতো শহরে বাস-অটো বা টোটো চলেছে। হাওড়া-বর্ধমান মেন ও কর্ড, শেওড়াফুলি-তারকেশ্বর বা কাটোয়া শাখায় ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক ছিল। অন্যান্য বারের মতো এ দিনের ধর্মঘটে জেলার কোথাও রাস্তা বা রেল অবরোধের খবর মেলেনি। অন্য দিকে, ‘সিঙ্গুর দিবস’ পালনের জন্য তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন জায়গায় মিছিল করেছেন। আবির মেখে মোটরবাইকে চক্কর কেটেছেন। জেলার বিভিন্ন রুটের বাস মালিক বা অটো চালকরা জানিয়েছেন, অন্যান্য দিনের তুলনায় অল্প বাস চলেছে। তবে তাতেও যাত্রীদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। ফেরি সার্ভিসের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
জেলা আদালতে বিচারপ্রার্থীদের উপস্থিতি ছিল অনেক কম। শ্রীরামপুর আদালতেও কোনও কাজ হয়নি বললেই চলে। তবে প্রশাসনিক দফতরগুলিতে হাজিরা যথেষ্ট ভালই ছিল। জেলাশাসক দফতর থেকে শুরু করে খাদ্যভবনে ৭০ শতাংশ কর্মী হাজির ছিলেন। শ্রীরামপুর পুরসভায় কর্মী থেকে অফিসারদের উপস্থিতি ছিল ভালই। কলকাতা বা সল্টলেক থেকেও অফিসাররা এ দিন নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে যান। তবে বিভিন্ন দফতরে উৎসবের মেজাজ লক্ষ্য করা গিয়েছে। এই পুরসভায় কর্মীরা কাজের ফাঁকে কার্যত চড়ুইভাতি সেরে ফেললেন।
পান্ডুয়া, ধনেখালি, বলাগড়ের মতো গ্রামীণ এলাকায় দোকানপাট খোলা ছিল। তবে স্কুল-কলেজে পড়ুয়াদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। সকালে পান্ডুয়ার ধামাসিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক সুজিতকুমার রায় এসেছিলেন। সিপিএমের লোকজন গিয়ে স্কুল বন্ধ করে দেয়। ধর্মঘট সমর্থনকারীদের কথা মতো প্রধান শিক্ষক বাড়ি ফিরে যান। পরে তৃণমূলের লোকজন তাঁকে স্কুল খুলতে বলেন। ওই কথা শুনে ফের তিনি স্কুলে আসেন। তবে পড়ুয়ারা আসেনি।
হুগলির মতো হাওড়াতে ধর্মঘটের মিশ্র প্রভাব পড়েছে। বাগনান, উলুবেড়িয়া, আমতা, শ্যামপুর, ডোমজুড়-সহ সর্বত্রই অর্ধেকের বেশি দোকানপাট খোলা ছিল। ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে কোনও সংঘর্ষের খবর নেই। সরকারি অফিসগুলিতেও হাজিরার সংখ্যা একশো শতাংশ ছিল বলে জানিয়েছেন উলুবেড়িয়ার মহকুমাশাসক অংশুল গুপ্ত ও হাওড়া সদর মহকুমাশাসক রেশমা বন্দ্যোপাধ্যায় (দেবনাথ) । জেলার বেশিরভাগ রুটেই সকালের দিকে বাস চললেও বেলা বাড়লে অনেক রুটের বাস বন্ধ করে দেন বাসমালিরা। তবে প্রতি রুটেই অন্য দিনের থেকে তুলনামূলকভাবে কম হলেও অটো, ছোট গাড়ির সংখ্যা মোটামুটি ছিল। ফলে যাঁরা পথে বেরিয়েছিলেন তাঁদের খুব বেশি সমস্যায় পড়তে হয়নি বলেই যাত্রীরা জানিয়েছেন। তবে সরকারি বাস থাকলেও সংখ্যায় কম ছিল।
তথ্য: পীযূষ নন্দী, তাপস ঘোষ, সুশান্ত সরকার, প্রকাশ পাল ও মনিরুল ইসলাম
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy