Advertisement
০২ মে ২০২৪

স্বপ্নভঙ্গের বেদনা ফরাসি শহরে

চোখের জল ধরে রাখতে পারছিলেন না ওঁরা। রবিবার রাত তখন প্রায় তিনটে। বাইরে ঝিরঝরে বৃষ্টি। চন্দননগরের শরৎ সঙ্ঘ, বিবিরহাট সন্তান সঙ্ঘ, কুঠির মাঠ, চাঁপাতলা খেলাঘর, ওরিয়েন্টাল ক্লাবের মধ্যে তখন শুধু সারি সারি মাথা।

ইউরো কাপ

ইউরো কাপ

প্রকাশ পাল ও তাপস ঘোষ
চন্দননগর শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৬ ০২:১০
Share: Save:

চোখের জল ধরে রাখতে পারছিলেন না ওঁরা।

রবিবার রাত তখন প্রায় তিনটে। বাইরে ঝিরঝরে বৃষ্টি। চন্দননগরের শরৎ সঙ্ঘ, বিবিরহাট সন্তান সঙ্ঘ, কুঠির মাঠ, চাঁপাতলা খেলাঘর, ওরিয়েন্টাল ক্লাবের মধ্যে তখন শুধু সারি সারি মাথা। কিন্তু কেউ কোনও কথা বলছেন না।

আচমকা যে স্বপ্নভঙ্গ হল! পর্তুগালের এডারের শট জড়িয়ে গেল ফ্রান্সের জালে। ফুটবলে ইউরোপ সেরার তকমা জুটল না ফ্রান্সের। কিছুক্ষণ পরে শুধুই হা-হুতাশ ওই সব ক্লাবে। পড়ে রইল আবির, বাজি-পটকা।

গঙ্গাপাড়ের চন্দননগর ছিল ফরাসিদের উপনিবেশ। বিশ্ব ফুটবলে বাঙালি যখানে ব্রাজিল-আর্জেন্তিনা-জার্মানিতে মজে থাকে, সেখানে চন্দননগর মনেপ্রা‌ণে ফ্রান্সের সমর্থক। ১৯৯৮ সালে ব্রাজিলকে হারিয়ে ফ্রান্স বিশ্বকাপ জেতার পরে এই শহরের পাড়ায়-পাড়ায় বিজয় মিছিল হয়েছিল। আবির উড়েছিল। বাজি ফেটেছিল। ২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনালে ইতালির কাছে টাইব্রেকারে হেরে গিয়েছিল ফ্রান্স। মন খারাপ হয়ে যায় এ শহরের।

কিন্তু এ বার ইউরো কাপের প্রথম ম্যাচ থেকে পায়েত, গ্রিজম্যানদের খেলা দেখে ফের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল চন্দননগর। না হোক বিশ্বকাপ, ইউরোপ সেরার তকমা তো! স্বপ্ন দানা বাঁধছিল দ্রুত। কোয়ার্টার ফাইনালে আইসল্যান্ডকে ৫-২, সেমিফাইনালে জার্মানিকে ২-০ গোলে হেলায় হারিয়ে ফাইনালে উঠেছিল কবিতার দেশ। প্রতিটি ম্যাচের শেষে উল্লাস করেছে চন্দননগর। তবে উৎসব করেনি।

বিজয় উৎসবের সবটুকু ১০ জুলাই রাতের জন্যই তুলে রেখেছিল সাবেক ফরাসডাঙা। কোর্টের কাছে, কুঠির মাঠের আশপাশে, পাতালবাড়ির কাছে পতপত করে উড়ছিল নীল-সাদা-লাল পতাকা। আলোর মালায় সাজানো হয়েছিল বেশিরভাগ ক্লাব। লাগানো হয়েছিল জায়ান্ট স্ক্রিন। ফ্রান্সের জয় সম্পর্কে এতটাই নিশ্চিত ছিলেন এ শহরের সমর্থকেরা যে ওই রাতেই বিজয়-মিছিলের ‘রুট’ পর্যন্ত ঠিক হয়ে গিয়েছিল। এ দিন সন্ধ্যায় শহরের একটি মাঠে ফুটবল প্রতিযোগিতায় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শহরের ছেলে, প্রাক্তন ফুটবলার কৃষ্ণগোপাল চৌধুরী, স্বপন পলসাই, বিভাস সরকার, তপন বসুরা। সেখানেও নিজেদের মধ্যে আলোচনা তাঁদের বাজি ছিল ফ্রান্স।

ফাইনাল শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে কাঁদতে কাঁদতে স্ট্রেচারে শুয়ে মাঠে ছেড়েছিলেন পর্তুগালের ‘গেমমেকার’ ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। একের পর এক ফরাসি আক্রমণ সামলাতে তখন পর্তুগাল ন’জনে মিলে রক্ষণ সামলাচ্ছে। কত গোলে ফ্রান্স জিতবে তা নিয়ে জোর চর্চাও শুরু হয়ে যায় ক্লাবগুলিতে। কিন্তু খেলার ১০৯ মিনিটের মাথায় সব চর্চা শেষ। ইউরো চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল পর্তুগাল।

খেলা শেষে ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন শরৎ সঙ্ঘের কর্তা সনৎ দাস। তাঁর কথায়, ‘‘চন্দননগরের সাথে ফ্রান্সের আত্মিক যোগ রয়েছে। সে জন্যই আমরা ফ্রান্সকে সমর্থন করি। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে জিদানদের জয়ে খুব মজা করেছিলাম। এ বারও ভেবেছিলাম, প্রিয় দলই জিতবে। কিন্তু এ কী হল!’’

ফরাসিদের আমল থেকেই চন্দননগর পৃথক ক্রীড়া জেলার মর্যাদা পায়। সেই চন্দননগর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক বামাপদ চট্ট্যোপাধ্যায়ও শোক চেপে রাখতে পারছিলেন না। তিনি বলেন, ‘‘ফ্রান্সের সঙ্গে চন্দননগরের নাম ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। এমনটা হবে, একদমই আশা করিনি।’’ প্রাক্তন ফুটবলার কৃষ্ণগোপালও বলেন, ‘‘গ্রিজম্যান, পোগবা, পায়েতরা যা ফর্মে ছিল, ভেবেছিলাম জয়টা সময়ের অপেক্ষা। রোনাল্ডোর চোট কাজে লাগানো গেল কই!’’

শহরে আর বাজি পোড়েনি। বিজয়-মিছিল বেরোয়নি। ওই রাতে বৃষ্টির জলে মিশে যাচ্ছিল চন্দননগরের চোখের জলও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Chandanagar France euro final
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE