Advertisement
০৫ মে ২০২৪

হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে মৃত্যু শিশুর

বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই বেলুড় জনতা স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ত একতা।

একতা শর্মা

একতা শর্মা

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৭ ০২:২৯
Share: Save:

স্কুলে যাওয়ার সময়ে বারবার করে মায়ের কাছে পিৎজা খাওয়ার বায়না করেছিল ছোট্ট মেয়েটা। বেতন পেলেই তা কিনে আনবেন বলে বুঝিয়ে মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে নিজেও কাজে বেরিয়েছিলেন মা। ভেবেছিলেন, কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে কিছু একটা কিনে নিয়ে যাবেন ছ’বছরের মেয়েটার জন্য। কিন্তু তার আগেই এল দুঃসংবাদ!

এলাকা থেকে ফোন করে মাকে জানানো হল, টোটোর ধাক্কায় রাস্তায় ছিটকে পড়েছে তাঁর মেয়ে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে নিয়ে স্থানীয়, জেলা থেকে কলকাতা মিলিয়ে চারটি হাসপাতালে পরিজনেরা ছোটাছুটি করলেও শেষরক্ষা হয়নি। কয়েক ঘণ্টা লড়াই চলানোর পরে মৃত্যু হল মেয়েটির। চিকিৎসকেরা জানান, শিশুটির একটি পা ভেঙে গিয়েছিল। চোট পেয়ে মাথাতেও রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। আর বুকের পাঁজরের হাড় ভেঙে ঢুকে গিয়েছিল ফুসফুসে।

বুধবার দুপুরে ঘটনাটি ঘটেছে বেলুড়ের ঠাকুরান পুকুর এলাকায়। শিশুটির নাম একতা শর্মা। ঘটনায় টোটোচালককে আটক করেছে বেলুড় থানার পুলিশ। তবে এই ঘটনায় একটি প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই উঠে এসেছে। তা হল, দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত অবস্থায় কেন এক হাসপাতাল থেকে আর এক হাসপাতালে ছুটে বেড়াতে এল ওই শিশুকে?

একতার পরিবার সূত্রে খবর, ঘটনার পরেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল স্থানীয় টি এল জায়সবাল স্টেট জেনারেল হাসপাতালে। সেখানে মিনিট পনেরো রেখে এক্স-রে করে চিকিৎসকেরা সমস্যা গুরুতর বুঝে তাকে স্থানান্তরিত করেন হাওড়া জেলা হাসপাতালে। দুপুর আড়াইটে নাগাদ সেখানে একতাকে নিয়ে পৌঁছন পরিজনেরা। ওই হাসপাতালেও কিছু ক্ষণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে চিকিৎসকেরা শিশুটিকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। প্রশ্ন উঠেছে, সমস্যা গুরুতর বুঝেও শিশুটিকে জায়সবাল হাসপাতাল থেকে সরাসরি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে না পাঠিয়ে কেন জেলা হাসপাতালে পাঠানো হল? হাওড়ার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ভবানী দাস বলেন, ‘‘নিয়মানুযায়ী জায়সবাল হাসপাতাল শিশুটিকে জেলা হাসপাতালে পাঠিয়েছিল। খোঁজ নিয়ে দেখেছি হাওড়া জেলা হাসপাতালও মাত্র কিছু ক্ষণের জন্য রেখে শিশুটিকে পরীক্ষা করেই অবস্থা আশঙ্কাজনক বুঝে স্থানান্তরিত করে দেয়।’’

শিশুটির পরিজনেরা জানান, হাওড়া থেকে বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ তাঁরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছন। সেখানে কয়েক জন চিকিৎসক মিলে শিশুটিকে পরীক্ষা করার পরে জানিয়ে দেন, তার অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যেতে হবে। সেই মতো সওয়া চারটে নাগাদ সেখানে পৌঁছে একতাকে ভর্তি করেন পরিজনেরা। রাতে সেখানেই তার মৃত্যু হয়।

প্রশ্ন হল, একতার যে ধরনের সমস্যা হয়েছিল তাতে কি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার চিকিৎসা করা যেত না? তা না করে

কেন শিশুটিকে এনআরএস-এ পাঠানো হল? মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ অবশ্য এ দিন দাবি করেছেন, তাঁদের কাছে এমন কোনও অভিযোগ জমা পড়েনি।

পুলিশ সূত্রের খবর, ঠাকুরান পুকুরের বাসিন্দা মনোজ ও সরোজ শর্মার বড় মেয়ে একতা। তাঁদের একটি ছোট ছেলেও আছে। স্বামী মনোজ সেই ভাবে কিছু করেন না বলে সন্তানদের মানুষ করার জন্য পুরসভার চুক্তিভিত্তিক স্বাস্থ্যকর্মীর পাশাপাশি স্থানীয় একটি শপিং মলেও কাজ নিয়েছিলেন সরোজ। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই বেলুড় জনতা স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ত একতা।

সরোজদের পাশের বাড়িতেই থাকেন তাঁর দিদি বেবি সিংহ। প্রতিদিন সরোজ কাজে বেরিয়ে যাওয়ার পরে একতা ও তার ভাই মাসির কাছে থাকত। বুধবার সকাল সাড়ে ৬টায় স্কুলে গিয়েছিল একতা। অঙ্ক পরীক্ষা দিয়ে ফিরে মাসির কাছে দুধ-বিস্কুট খাওয়ার পরে দুপুর ১টা নাগাদ এলাকারই মন্দিরে খেলতে গিয়েছিল। বেবি বলেন, ‘‘খেলতে যাওয়ার সময়ে বললাম, ‘তাড়াতাড়ি চলে আসিস। দুপুরে ভাত খেয়ে তিনটের সময়ে দিদিমণির কাছে যেতে হবে।’’ দেড়টা নাগাদ বাড়ি ফিরতে গিয়েই ঘটে দুর্ঘটনা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গিরিশ ঘোষ মেন রোড থেকে বাই লেনের মধ্যে রয়েছে মন্দিরটি। সেখানেই ঢুকছিল টোটো। রাস্তা পেরোতে গিয়ে সেই টোটোর ধাক্কায় একতা ছিটকে গিয়ে পড়ে পাশেরই একটি পাঁচিলে। রাত ৮টা নাগাদ এনআরএস-এ মৃত্যু হয় শিশুটির। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই গোটা এলাকা শোকস্তব্ধ। কান্নায় ভেঙে পড়ে সরোজের আক্ষেপ, ‘‘গত মাসেই মেয়ের জন্মদিন করলাম। এর মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেল।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dead Child
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE