Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
রায় শুনেই চোখে জল কৌশিকের, মুখ ঢাকার চেষ্টা শানুর
Balagarh Rape Case

ফাঁসিতে ‘স্বস্তি’ বলাগড়ের

নির্যাতিতার পরিবার তো বটেই, রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন আদালতে আসা গ্রামবাসীও।

দোষী: সাজা শোনার পর আদালত থেকে বেরিয়ে আসছে কৌশিক (চেক শার্ট) ও শানু। ছবি: তাপস ঘোষ

দোষী: সাজা শোনার পর আদালত থেকে বেরিয়ে আসছে কৌশিক (চেক শার্ট) ও শানু। ছবি: তাপস ঘোষ

নিজস্ব সংবাদদাতা
বলাগড় শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২০ ০২:২২
Share: Save:

পাঁচ বছর ধরে তাঁরা দিন গুনেছেন। সোমবার ‘স্বস্তি’ পেলেন।

বলাগড়ের যে গ্রামের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রীটিকে বছর পাঁচেক আগে মুক্তিপণের জন্য খুন করা হয়েছিল, সেই গ্রামের জনা পঁয়ত্রিশ বাসিন্দা এ দিন বাসভাড়া করে চুঁচুড়া আদালতে এসেছিলেন দোষীদের সাজা শুনতে। তাঁদের হাতে ছিল ফাঁসির দাবিতে প্ল্যাকার্ড। সেই সাজাই শোনালেন চুঁচুড়ার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক তথা পকসো মামলার বিশেষ বিচারক মানসরঞ্জন সান্যাল। নির্যাতিতার পরিবার তো বটেই, রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন আদালতে আসা গ্রামবাসীও।

এ দিন বেলা একটা নাগাদ দুই দোষী বলাগড়েরই জিরাট-হাটখোলার বাসিন্দা গৌরব মণ্ডল ওরফে শানু এবং কৌশিক মালিককে এজলাসে তোলা হয়। সাজা নিয়ে বিচারক তাদের বক্তব্য জানতে চান। তবে দু’জনেই জানিয়ে দেয়, তাদের কিছু বলার নেই। এর পরে বেলা আড়াইটে নাগাদ বিচারক সাজা ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার পরে এজলাস থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার সময় দণ্ডিতেরা সংবাদমাধ্যমের কোনও প্রশ্নের জবাব দেয়নি। কৌশিকের চোখে জল ছিল। গৌরব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে হাত দিয়ে মুখ ঢাকতে যায়।

মামলার বিশেষ সরকারি আইনজীবী সুব্রত গুছাইত জানান, খুনের (৩০২) দায়ে ওই দু’জনকে ফাঁসির সাজা দিয়েছেন বিচারক। মুক্তিপণের জন্য অপহরণ (৩৬৪এ), নাবালিকাকে ধর্ষণ (৩৭৬ (২) (১)) এবং সমবেত ভাবে একই অপরাধ ঘটানোর (৩৪) ধারায় তাদের যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন। প্রোটেকশন অব চিল্ড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস অর্থাৎ পকসো আইনের ৬ নম্বর ধারায় ২০ বছর সশ্রম কারাবাসের সাজা দেওয়া হয়েছে। অপহরণের (৩৬৩) ধারায় ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের সাজা শোনানো হয়েছে। খুনের পরে প্রমাণ লোপের ধারাতেও (২০১) পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের শাস্তি দিয়েছেন বিচারক।

আদালতে এসেছিলেন নির্যাতিতার বাবা। রায় শুনে তিনি বলেন, ‘‘আমি খুশি। পাঁচ বছর ধরে এই জন্যই তো লড়াই করেছি। এ বার শাস্তি কার্যকর হলেই হয়।’’ একরত্তি দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে এ দিন বাড়িতেই ছিলেন নির্যাতিতার মা। অপরাধীদের সাজার প্রশ্নে তিনিও বলেন, ‘‘এই ক’টা বছর শুধু ঠাকুরকে ডেকেছি। মেয়ের খুনিদের চরম শাস্তি চেয়েছি। ওদের ফাঁসির সাজা হয়েছে ভাল। কিন্তু যত দিন না এই সাজা কার্যকর হচ্ছে, তত দিন নিশ্চিন্ত হতে পারব না।’’

পুলিশ জানিয়েছে, ২০১৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বিকেলে বছর এগারোর মেয়েটি জিরাটে টিউশন পড়তে গিয়েছিল। রাত আটটা নাগাদ সাইকেলে চেপে বাড়ি ফেরার সময় হাটখোলায় শানু, কৌশিক এবং দ্বাদশ শ্রেণির এক ছাত্র মেয়েটিকে অপহরণ করে। ভয়ে মেয়েটি চিৎকার করায় এলাকার একটি কারখানার পিছনে নিয়ে গিয়ে তাকে গলা টিপে মেরে ফেলে। সেখানেই দেহ ফেলে রেখে জিরাটের একটি হোটেলে তারা খাওয়া-দাওয়া সারে। গভীর রাতে দেহটি মোটরবাইকে চাপিয়ে তারা গঙ্গার চরে নিয়ে যায়। সেখানে মৃতদেহের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করে। তারপরে দেহটি একটি চটের বস্তায় ভরে সেখানে গর্ত করে পুঁতে ফেলে। পুরো দেহ বস্তায় না-ঢোকায় কোদালের বাঁট দিয়ে মেরে মেয়েটির পা ভেঙে দেয়।

মেয়েটি না-ফেরায় বাড়ির লোকজন এবং পড়শিরা রাত থেকেই তার খোঁজ শুরু করেন। মেয়েটির মোবাইল ফোন বেজে যেতে থাকে। পরে শানুরা ফোন ধরে মেয়েটির পরিজনদের কাছ থেকে তিন লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে এবং জানায়, টাকা কোথায় দিতে হবে তা পরে জানানো হবে। মেয়েটির বাবার বাড়িতে নার্সির রয়েছে। পরের দিন তিনি বলাগড় থানায় অপহরণের অভিযোগ করেন। ওই রাতেই শানু, কৌশিক এবং দ্বাদশ শ্রেণির ওই ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। ১৪ ডিসেম্বর ভোরে গঙ্গার চরের মাটি খুঁড়ে নির্যাতিতার দেহ মেলে। তার পোশাক অবিন্যস্ত ছিল। গঙ্গার পাড় থেকে মেলে তার সাইকেল। ঘটনাস্থলের কাছেই তার চটিজোড়াও পাওয়া যায়। জেরায় অপরাধ কবুল করে ধৃতেরা।

ঘটনার ৯০ দিনের মধ্যে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী অফিসার সোমনাথ দে। ধরা পড়া ইস্তক কৌশিক এবং গৌরব জামিন পায়নি। ঘটনার সময় বয়স আঠেরো বছরের কম থাকায় আর এক অভিযুক্তের বিচার চলছে জুভেনাইল আদালতে। ওই ছাত্রীর দেহ উদ্ধারের পর পরই কৌশিক, শানু এবং অপর এক অভিযুক্তের বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়েছিল জনতা। এক জনের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দোষীদের শাস্তির দাবিতে মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন। একাধিক মিছিল হয়েছিল। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাও তাতে শামিল হয়েছিল। জিরাট পঞ্চায়েতের উপপ্রধান অশোক পোদ্দার বলেন, ‘‘এমন সাজায় বিকৃত রুচির লোকেরা এমন অপরাধ ঘটাতে একশো বার ভাববে।’’

পাঁচ বছর আগে গঙ্গার যে চরের জায়গা থেকে ছাত্রীর দেহ উদ্ধার হয়েছিল, এ দিন সেই জায়গায় জড়ো হয়েছিলেন কিছু গ্রামবাসী। দিনভর আলোচনায় ছিল দোষীদের শাস্তি। জিরাট-হাটতলার বাসিন্দা অসীম মজুমদার বলেন, ‘এলাকার বদনাম হয়ে গিয়েছিল। আমি ভলিবলের প্রশিক্ষণ দিই। ওই ঘটনার উদাহরণ দিয়ে বাবা-মায়েরা মেয়েদের খেলতে পাঠাতে চাইতেন না ফিরতে সন্ধ্যা হবে বলে। এই রায়ের পরে কেউ হয়তো এমন দুষ্কর্ম করতে সাহস পাবে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Balagarh Rape Case Chinsurah Court Death Sentence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE