Advertisement
E-Paper

বেহাল স্বাস্থ্যই নয়, সামগ্রিক উন্নতি চান শহরবাসী

নাগরিকদের জীবনযাত্রার মানের নিরিখে হুগলির এই প্রাচীন জনপদ আর পাঁচটা জনপদের মতো কতটা এগিয়েছে? সহজ উত্তর হল, এখানে নাগরিক পরিষেবার হাল যেন তার প্রাচীনতার সঙ্গে মানানসই হয়ে গিয়েছে। তাই দীর্ঘ বছরের অনেক না পাওয়া নিয়ে ইতিহাসের গরিমা আর পর্যটনকে কেন্দ্র করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে গুপ্তিপাড়া।

প্রকাশ পাল

শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৫ ০১:২২
স্বাস্থকেন্দ্র থাকলেও পরিষেবা নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই।

স্বাস্থকেন্দ্র থাকলেও পরিষেবা নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই।

নাগরিকদের জীবনযাত্রার মানের নিরিখে হুগলির এই প্রাচীন জনপদ আর পাঁচটা জনপদের মতো কতটা এগিয়েছে? সহজ উত্তর হল, এখানে নাগরিক পরিষেবার হাল যেন তার প্রাচীনতার সঙ্গে মানানসই হয়ে গিয়েছে। তাই দীর্ঘ বছরের অনেক না পাওয়া নিয়ে ইতিহাসের গরিমা আর পর্যটনকে কেন্দ্র করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে গুপ্তিপাড়া। রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে ডবল লাইন হয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন জেলা থেকে এখানে লোকজনের আসা বেড়েছে। কিন্তু সারাদিন শহরে থেকে ফের ফিরে যেতে হয় তাঁদের। এই অবস্থায় পরিকাঠামোর উন্নতি যে অবিলম্বে দরকার তা স্বীকার করে প্রশাসনও।

এলাকায় ঘুরলে বোঝা যাবে স্বাস্থ্য থেকে পরিবহণ, রাস্তাঘাট সর্বত্রই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা থাকলেও যেন একটা শিথিলতা থেকে গিয়েছে।

শহরে কোনও বাসস্ট্যান্ড নেই। যদিও রেল স্টেশনের পাশে বা শহরের অন্যত্র জায়গার অভাব নেই। কিন্তু এ নিয়ে কারও কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি। অনেক রাস্তা আজও মাটি বা মোরামের। সুলতানপুর মসজিদ থেকে কুলিয়াপাড়া বাজার, আয়দা ঘোষপাড়া মোড় থেকে সোমড়াবাজার স্টেশন, টেংরিপাড়া থেকে বিন্ধ্যবাসিনী তলা হয়ে বেনালি চর এ সব রাস্তার কেন সংস্কার হয়নি তার কোনও উত্তর নেই প্রশাসনের কাছে।

গুপ্তিপাড়া ২ পঞ্চায়েত এলাকায় রয়েছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। আশপাশের বেশ কয়েকটি পঞ্চায়েতের মানুষের প্রাথমিক ভরসা এটাই। কিন্তু সমস্যা একটু জটিল হলেই পত্রপাঠ চল্লিশ কিলোমিটার দূরে চুঁচুড়ায় জেলা সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়াটাই দস্তুর! স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি বেশ পুরনো। এক সময়ে প্রসূতি বিভাগে ১০টি শয্যা ছিল। মাঝে তা বন্ধ হয়ে যায়। দু’বছর আগে রাজ্য সরকার এখানে দশ শয্যার অন্তর্বিভাগের উদ্বোধন করে ৭৬ লক্ষ টাকা ব্যয়ে। মানুষ আশায় ছিলেন, স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল ফিরবে এ বার। দু’বছর বছর পরে সেই উদ্যোগ কতাটা সফল একবার দেখে নেওয়া যাক। আগে মাত্র কয়েক ঘণ্টা চিকিৎসকের দেখা মিলত। এখন ছবিটা বদলেছে। দু’জন চিকিৎসক পরিষেবা দিচ্ছেন। কিন্তু সাধারণ জ্বর, হাঁচি-কাশি-সর্দি বা ছোটখাট সেলাইফোঁড়াই এবং ডায়েরিয়া বাদ দিয়ে অন্য চিকিৎসা মেলে না। প্রসূতিদের সিজার ব্যবস্থা চালু হয়নি। ইসিজি, এক্স-রে, প্যাথলজি — না এর কোনও সুবিধাই এখানে পাওয়া যাবে না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক? তাও পাবেন না। অতএব, সমস্যা একটু জটিল হলেই অনেকটা পথ উজিয়ে পাশের জেলা বর্ধমানের কালনা হাসপাতাল অথবা চুঁচুড়া ইমামবাড়া হাসপাতালে ছুটতে হয়। কখনও সেই গন্তব্য হয় বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এতটা পথ যেতে মুমুর্ষু রোগীর যে কি হাল হয় তা সহজেই অনুমান করা যায়।

বিন্ধ্যবাসিনী মন্দিরের যাওয়ার রাস্তার হাল।

গুপ্তিপাড়া ছুতোরপাড়ার বাসিন্দা অসিত কুণ্ডু বলেন, ‘‘কয়েক দিন আগে হৃদরোগের কারণে বুকে যন্ত্রণা হয়েছিল। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতেই কালনায় চলে যেতে বলল। প্রাথমিক চিকিৎসাটুকুও না পেয়ে এতটা পথ যেতে হয়েছে। বেঁচে ফিরেছি, এটাই অনেক।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘চুঁচুড়া বা কালনার হাসপাতালে যেতে হাজার টাকা গাড়িভাড়া গুনতে হয়। গরিব মানুষ এত টাকা পাব কোথায়!’’

অসিতবাবুর অভিজ্ঞতা অবশ্যই তাঁর একার নয়। অথচ, গুপ্তিপাড়া ১ ও ২, চরকৃষ্ণবাটি, সোমড়া ১, বাঁকুলিয়া-ধোবাপাড়া পঞ্চায়েত এলাকার মানুষ এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপরেই নির্ভরশীল। কালনার সাতগাছিয়া পঞ্চায়েত থেকেও গ্রামবাসীরা এখানে চিকিৎসার জন্য আসেন। এক সময় কালাজ্বরের আঁতুরঘর ছিল বাঁকুলিয়া ও সংলগ্ন এলাকা। বর্ষায় জলবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়ে। এই অবস্থায় স্বাস্থ্য দফতরের লোক শেষ কবে এলাকায় এসেছিল, তা মনে করতে পারেন না এখানকার মানুষ।

জটিল রোগের কথা বাদই দেওয়া যাক। স্থানীয় কলেজ পড়ুয়া প্রসেনজিৎ বর্মনের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। কুকুরে কামড়ানোর ইঞ্জেকশন নিতে এসে না পেয়ে ফিরে যেতে হয়েছে তাঁকে। বাঁধাগাছির গোবিন্দ বিশ্বাসের অভিজ্ঞতাও একই! এলাকার লোকজনের ক্ষোভ, সব সময় অ্যাম্বুল্যান্স মেলে না। সরকারি অ্যাম্বুল্যান্স নেই। অনেক ক্ষেত্রে রোগীকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার পথেই অঘটন ঘটে যায়। হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানালেন, এখানে স্বাভাবিক প্রসব হয়। ডায়েরিয়া রোগীদের ভর্তি রাখার পৃথক বন্দোবস্ত রয়েছে। যতক্ষণ সম্ভব পরিষেবা দেওয়া হয়। কিন্তু পুরোদস্তুর হাসপাতালের মতো পরিষেবা দেওয়ার মতো পরিকাঠামো কোথায়!

শুধু চিকিৎসাই নয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অন্যান্য বিষয় নিয়েও অভিযোগের অন্ত নেই। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চারদিকে সীমানা প্রাচীর নেই। স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বর সব্জি বা অন্য ব্যবসায়ীদের জিনিস রাখার জায়গা হয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যা নামলেই বসে যায় মদের ঠেক। বাসিন্দাদের অভিযোগ, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আশপাশের বাতিস্তম্ভ থাকলেও তাতে আলো জ্বলে না। দুষ্কৃতীরাই আলোর বিদ্যুৎ সংযোগ নষ্ট করে দিয়ে‌ছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বর পরিচ্ছন্ন রাখার দিকেও নজর নেই প্রশাসনের। চার দিকে আগাছা, ঝোপঝাড়ে সাপের উপদ্রব উপরি পাওনা।

জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা শুভ্রাংশু চক্রবর্তী বলেন, ‘‘অনেক প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র আছে, যেখানে শুধু বহির্বিভাগে রোগী দেখা হয়। গুপ্তিপাড়ায় কিন্তু এখন সর্বক্ষণ চিকিৎসক থাকছেন। উন্নত পরিষেবার যে দাবি উঠেছে, তা আমাদের কাছে পাঠালে রাজ্য সরকারকে জানাব।’’ কালাজ্বরের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য দফতর নজরদারি চালায় বলে তিনি দাবি করেন।

স্থানীয় বাসিন্দা সনাতন চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষোভ, ‘‘ইতিহাসের পাতায় গুপ্তিপা়ড়ার নাম রয়েছে। এত গৌরব এখানে। কিন্তু এমন জায়গার নাগরিকদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কেন তিমিরেই পড়ে থাকবে! গত দু’বছরে সরকার চেষ্টা করেছে ঠিকই, কিন্তু তাতে লাভ হয়েছে কোথায়?’’ রায়পাড়ার বাসিন্দা, প্রাক্তন ব্যাঙ্ক অফিসার সুব্রত লাহিড়ী বলেন, ‘‘শ্রী সারদা মঠ ও রামকৃষ্ণ সারদা মিশনের প্রথম প্রেসিডেন্ট প্রব্রাজিকা ভারতীপ্রাণা গুপ্তিপাড়ার মেয়ে। তখন তাঁর নাম ছিল পারুল মুখোপাধ্যায়। সিস্টার নিবেদিতার স্কুলে সুধীরাদেবীর কাছে শিক্ষা নেওয়ার সময় তিনি নার্সিং শিখেছিলেন। দীর্ঘদিন সারদাদেবীর সেবাও করেছিলেন। এ হেন মহিয়সীর জন্মস্থানে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর এমন অবস্থা সত্যিই দুর্ভাগ্যের।’’

এই পরিস্থিতিতে পর্যটনের হাত ধরে যদি স্বাস্থ্যকেন্দ্র-সহ অন্যান্য পরিকাঠামোর উন্নতির অপেক্ষায় শহরবাসী। আর সে জন্য রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর দিকেই তাকিয়ে গুপ্তিপাড়া।

(চলবে)

—নিজস্ব চিত্র।

Guptipara Development Sultanpur Prakash Pal southbengal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy