প্রান্তিক মানুষ ছিলেন ভিখারি পাসোয়ান। ২৩ বছরেও তাঁর অন্তর্ধান রহস্যের সমাধান হল না।
তবে, ভিখারিকে ঘিরে ৯০-এর দশকে বামেদের বিরুদ্ধে যে ভাবে রাজ্য-রাজনীতি তোলপাড় হয়েছিল, তাতে শুধু মমতা বন্দ্যেপাধ্যায় রাজনৈতিক ফায়দা পাননি, তাঁর অনুগামী কংগ্রেস নেতা আকবর আলি খন্দকারও নিজের রাজনৈতিক জমি মজবুত করেছিলেন। কেননা, বামেদের বিরুদ্ধে জোরালো ভাবে বিরুদ্ধ স্বরের সেই শুরু!
সেই সময় বিরোধী যুব কংগ্রেস নেত্রী মমতার তেলেনিপাড়ায় ঢোকার উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল জ্যোতি বসুর সরকারের। কেননা, তেলেনিপাড়ার মতো মিশ্র ভাষাভাষির স্পর্শকাতর এলাকায় প্রশাসনকে সদাসতর্ক থাকতে হয়। বাম আমল থেকে রাজ্যের বিদায়ী প্রশাসকেরা সেখানে স্থায়ী ভাবে এক কোম্পানি ইএফআর বছরভর রেখে দিয়েছেন প্রয়োজনে পরিস্থিতির মোকাবিলায়। পুলিশ রিপোর্ট বলছে, চটকল অধ্যুষিত শ্রমিক মহল্লাগুলিতে বহু সময় দাগি দুষ্কৃতীরা ডেরা বাঁধে। অনেক সময় অশিক্ষিত শ্রমিকদের কাজে লাগিয়ে দুষ্কৃতীরা মহল্লায় অনর্থ বাধিয়ে ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দেয়। পুলিশ টিকিটি খুঁজে পায় না।
এখন নিজে প্রশাসক হলেও মমতা কিন্তু সেই আমলে কখনই প্রশাসনের নিষেধ মানেননি। বাধার ‘হার্ডল’ পেরনোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণের খেলা তাঁর বরাবরের পছন্দের। শুধু বৈদ্যবাটি রেলগেটে মমতাকে আটকানো নয়, সরাসরি তেলেনিপাড়ায় তাঁকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না বলে সেই সময় প্রশাসনের তরফে আগাম জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সে সবের থোড়াই কেয়ার করেন মমতা। হুগলিতে কংগ্রসের তৎকালীন জেলা নেতা আকবর আলি খন্দকারকে মমতা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তেলেনিপাড়া বাজারে সভা হবেই। বাধা দিলে বাধবে লড়াই।
সেই সভা হয়েছিল। প্রশাসনকে বলে দেওয়া হয়, ভিখারিকে খুঁজে বের করতে প্রশাসন যত সময় নেবে আন্দোলন ততই দীর্ঘায়িত হবে। একই দাবিতে যুবনেত্রীর পাশাপাশি সেই সময় একটি মানবাধিকার সংগঠনও পথে নামে। সুজাত ভদ্র, সচ্চিদানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রেখে তারা একটি ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম’ তৈরি করে। নিজস্ব সূত্র মারফত সংগঠনের তরফে ঘটনার তদন্তও শুরু হয়।
মমতার নির্দেশে আকবর আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে কলকাতা হাইকোর্টে ভিখারি অন্তর্ধান মামলার তোড়জোড় শুরু করেন। তেলেনিপাড়ার সভামঞ্চে মমতা ভিখারির মা লক্ষ্মীদেবীকে দিয়ে একই দাবি তুলে ধরেন। নিজের নিখোঁজ ছেলেকে যেহেতু পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল, তাই সরকারেরই দায়িত্ব তাকে খুঁজে দেওয়ার বলে দাবি করেন লক্ষ্মীদেবী। সেই মর্মে তিনি এবং তাঁর স্বামী লক্ষ্মীচাঁদ পাসোয়ান আদালতে আবেদনও করেন। পুলিশ যথারীতি ভিখারিকে খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়। রাজ্য সরকারের বিড়ম্বনা বাড়ে। সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে চলে আসে ভিখারি-কাণ্ড।
ভিক্টোরিয়া চটকলে গোলমালের ঘটনায় জেরার জন্য এক রাতে তিন পুলিশ কর্মী ভিখারিকে তেলেনিপাড়ার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আসে বলে অভিযোগ। তাঁর স্ত্রী ও মা তেলেনিপাড়া ফাঁড়িতে গিয়ে সেই সময় কেঁদে ফেলেছিলেন। পুলিশের ‘মুড’ যে ভাল নয়, সে আঁচও পেয়েছিল আতঙ্কিত পাসোয়ান পরিবার। আইপিএস অফিসার হরমনপ্রীত সিংহ সেই সময় ছিলেন হুগলির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হেড কোয়ার্টার)। গোলমাল আঁচ করে হরমনপ্রীতের নির্দেশে ভিখারিকে চুঁচুড়া খাদিনা মোড়ের ধরমপুর ফাঁড়িতে নিয়ে আসা হয় বলে অভিযোগ। তার পর থেকে তাঁর আর হদিস মেলেনি।
ওই ঘটনা শুধু মমতা নয়, প্রয়াত আকবর আলি খন্দকারকেও রাজনৈতিক ভাবে শক্ত জমির উপর দাঁড় করিয়ে দেয়। চটকল-শ্রমিক ভিখারির মতো একজন মানুষের হয়ে বিচার চাইতে মমতা আদালতে যাওয়ায় ফের রাজ্য-রাজনীতিতে কংগ্রেস প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। গঙ্গার উল্টো পাড়ের উত্তর ২৪ পরগনাতেও ওই ঘটনার রেশ গিয়ে পড়ে। পরিস্থিতি এতটাই ঘোরালো হয়ে ওঠে, তা দমন করতে ঘুঁটি সাজায় বাম সরকার। অভিযোগ, প্রথমে পুলিশ-প্রশাসন দিয়ে চাপে কাজ না হওয়ায় ভয়-ভীতি প্রদর্শনের রাস্তা নেওয়া হয়। তৎকালীন শাসকেরা পুলিশ মারফত এলাকার দুষ্কৃতী কাঁকড়াকে কাজে লাগায়। আকবরের শেওড়াফুলির স্টেশন লাগোয়া বাড়িতে ওই ঘটনার সময়ই কাঁকড়ার দলবল বোমা মারে বলে অভিযোগ। সেই সময় আকবর বাড়িতে ছিলেন। পুলিশ অবশ্য সেই অভিযোগ সে ভাবে আমল দেয়নি। তারপর আরও এক ঘটনার সাক্ষী হন আকবর। ভিখারির মা-বাবাকে নিয়ে আদালতে একটি হলফনামা জমা দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল প্রয়াত ওই নেতার। রাস্তায় তাঁদের গাড়ি রুখে অপহরণের ছক কষা হয়। কিন্তু কোনও সূত্রে খবর পেয়ে তাঁরা সে দিন গাড়ি ছেড়ে ট্রেন পথে হাওড়ায় পৌঁছে লঞ্চে আদালত পৌঁছন।
২৩ বছর পার। ভিখারির হদিস মেলেনি। সেই সময় চাপে পড়ে সরকার অভিযুক্ত তিন পুলিশকর্মীকে ( যাঁরা ভিখারিকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যান বলে অভিযোগ) সাময়িক বরখাস্ত করে। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে ছুটিতে থাকা পুলিশ সুপার সন্ধি মুখোপাধ্যায়কে কাজে ফেরান মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবাবু।
স্বামীর সে দিনের লড়াইয়ের কথা বলতে গিয়ে এখনও আবেগে গলা বুজে আসে প্রয়াত আকবরের স্ত্রী স্বাতীর। প্রান্তিক মানুষের হয়ে সেই লড়াই আকবরকে চণ্ডীতলা থেকে বিধানসভার চৌকাঠে পৌঁছে দিয়েছিল।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy