Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

রঙিনে হারিয়ে যায়নি সমীর, শম্ভুনাথের সাদা-কালোর শহর

সাহেবদের আনাগোনা এ তল্লাটে তখন যথেষ্ট। তা সে গঙ্গাপারে জুটমিলের পত্তন হোক বা অন্য কোনও কাজ। সে সব ঘটনাকে ফ্রেমবন্দি করে রাখতে এক তরুণের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। সালটা ১৯৩০। অবিভক্ত জার্মানিতে তৈরি জ্যুইস আইকন ক্যামেরায় সেই সব ছবি ধরে রাখতেন সন্তোষ কুমার মোদক।

ত্রিবেণী স্টেশনে বাস্পচালিত রেল ইঞ্জিন।

ত্রিবেণী স্টেশনে বাস্পচালিত রেল ইঞ্জিন।

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
ত্রিবেণী শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০১৫ ০১:৪৭
Share: Save:

সাহেবদের আনাগোনা এ তল্লাটে তখন যথেষ্ট। তা সে গঙ্গাপারে জুটমিলের পত্তন হোক বা অন্য কোনও কাজ। সে সব ঘটনাকে ফ্রেমবন্দি করে রাখতে এক তরুণের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। সালটা ১৯৩০। অবিভক্ত জার্মানিতে তৈরি জ্যুইস আইকন ক্যামেরায় সেই সব ছবি ধরে রাখতেন সন্তোষ কুমার মোদক। ফোটোগ্রাফির জগতে সেই পা রাখা মোদক পরিবারের। পর পর তিন প্রজন্ম পেরিয়ে গিয়েছে আর ক্যামেরা, ছবির জগতের সঙ্গে মোদক পরিবারের সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়েছে। আর ছবি তুলে বেড়ানোর নেশা ও পেশার মধ্যে দিয়ে এই শহর আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে এই পরিবারকে।

গোটা ত্রিবেণীই একটা ইতিহাস। গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী, তিন নদীর সঙ্গমস্থলের এই শহর যেমন ভৌগলিক কারণে গুরুত্ব পেয়েছে তেমনই এর সর্বত্র ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের নানা আকর। যা নানা সময়ে ক্যামেরায় নানা খণ্ডচিত্রে ধরা দিয়েছে এবং শহরকে চিনতে সাহায্য করেছে। তরুণ সন্তোষের ছবিতে জানতে পারা যায় গ্যাঞ্জেস জুটমিলে উৎপাদন শুরুর দিনগুলিতে এলাকার মানুষজনের পাশাপাশি সাহেবদের ভূমিকাও। অতীতের নানা গুরুত্বপূর্ণ মুখ ছবির মাধ্যমেই সেই সময় তাঁদের ভূমিকাকেও পরখ করতে সহায়ক হয়ে ওঠে।


প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন।

নাতিদীর্ঘ এ শহরে ছবি তোলার স্টুডিও রয়েছে কম বেশি সাত আটটি। তবে সময়ের নিয়মে আর আধুনিক প্রযুক্তির খবরদারিতে পুরনো কিছু স্টুডিও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ১৯২০ সাল। বেণীমাধব স্টোর্স নাম দিয়ে কাজ শুরু করেন সন্তোষ। ব্যক্তিগত পাসপোর্ট ছবির পাশাপাশি সেই সময় মূলত গ্রুপ ছবি তোলার একটা রেওয়াজ ছিল লোকজনের মধ্যে। পরবর্তী সময়ে সন্তোষবাবুর দেখাদেখি তাঁর পাঁচ ছেলেই এই পেশায় জড়িয়ে পড়েন। বড় সুনীল, মেজ সুশীল ও সেজ সলিল সকলেই কমবেশি ছবি তোলায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ছোট ছেলে সুদীপ্ত অধ্যাপনার কাজ করলেও ছবি তুলতে পারেন। ১৯৬৮ সালে ‘লাইট অ্যান্ড শেড’ নাম দিয়ে সন্তোষবাবুর চতুর্থ সন্তান সমীর ত্রিবেণীতে নতুন স্টুডিও করেন। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ছবি তোলার ফাঁকে নানা অভিজ্ঞতার ঝাঁপি মেলে ধরলেন সমীর। তাঁর কথায়, ‘‘এক সময় প্রফুল্ল সেন আর অতুল্য ঘোষেরা নিয়মিত আসতেন ত্রিবেণীতে। ওঁদের বহু ছবি আমার ক্যামেরায় বন্দি। বাবার কাছেই ছবি তোলার হাতেখড়ি আমার। তবে পুরনো ক্যামেরা আজও বিক্রি করিনি। জাপানে তৈরি মার্মিয়া ক্যামেরা এখনও আমার সঙ্গী। জানি না, আমার পরের প্রজন্ম এ সব ক্যামেরা যত্নআত্তি করতে পারবে কি না!’’

সমীরবাবুর ক্যামেরায় যেন মূর্ত হয়ে ওঠে ত্রিবেণী স্টেশনে হারিয়ে যাওয়া কয়লার রেল ইঞ্জিনের ছবি। শোনালেন ১৯৮১ সালে ব্যান্ডেল থার্মাল পাওয়ার স্টেশনের (বিটিপিএস) উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী জ্যেতিবাবুর ছবি তোলার গল্প। সমীরবাবুর ছেলে স্বাগতও নিজের স্টুডিও করেছেন এ শহরে। ফোটোগ্রাফি নিয়ে পড়াশোনাও। তাই পারিবারিক ঐতিহ্য রক্ষার প্রশ্নে এখন অনেকটাই নিশ্চিন্ত সমীরবাবু।

চুয়াল্লিশ বছর ধরে আরও একজনের ক্যামেরায় বেঁচে রয়েছে এই শহর, তিনি শম্ভুনাথ হালদার। এক সময় কলকাতা শহরে চুটিয়ে থিয়েটর করেছেন তিনি। সেই সূত্রেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সঙ্গে কাজ করার সুযোগও এসেছিল তাঁর। তবে পরবর্তী সময়ে ক্যামেরার পিছনেই নিজের জায়গা খুঁজে নিয়েছিলেন। তৈরি করেন ‘চিত্রায়ণ’ স্টুডিও। শম্ভুনাথবাবু বলেন, ‘‘এক সময় মার্মিয়া, রোলিফেক্স ক্যামেরায় কাজ করেছি। জার্মানিতে তৈরি ওই সব ক্যামেরা এখনও দুরন্ত।’’ তবে আক্ষেপও রয়েছে এই ফোটোগ্রাফারের। আর সেটাই ঝরে পড়ে তাঁর গলায়, ‘‘১২০ ফ্লিমই তো আর মেলে না। তাই সাদা কালোর ছবি তোলার যে মজা তা আর এখন কোথায়?’’

এক সময় ক্যামেরার পিছনে দাঁড়িয়ে যে মানুষগুলি দাপট দেখিয়েছেন, স্মৃতি রোমন্থনে আজ তাঁরা কেমন যেন আনমনা। অতীতের স্মরণি দিয়ে ফিরে যান সে সব দিনে। সময়ের ভারে থেমে থাকা নানা ক্যামেরার কথা বলতে গিয়ে গলা বুজে আসে। আবার তার মধ্যেই ফিনিক্স পাখির খোঁজ মেলার আশা নিয়ে সমীর, শম্ভুনাথরা বলে ওঠেন, ‘‘ফের যদি আরও একবার ওই সব ক্যামেরায় ‘ক্লিক’ করতে পারতাম।’’

মুহূর্তেই যেন ওঁরা ফিরে যান নিজেদের শুরুতে।

(চলবে)

ছবি সৌজন্যে: সমীর মোদক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE