রোগের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন বৃদ্ধ। গুরুতর জখম অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। তবে তাঁর দু’টি পা-ই হাঁটুর নীচে থেকে কেটে বাদ দিতে হয়েছে। ঘটনাটি ঘটে রবিবার সকালে হাওড়ার উলুবেড়িয়া রেল স্টেশনে। প্রসঙ্গত, বছর ষাটেকের ওই বৃদ্ধ নিরঞ্জন রায় উলুবেড়িয়া হাসপাতালেই ভর্তি ছিলেন।
এই ঘটনায় রোগীর পরিবারের তরফে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও কী ভাবে একজন রোগী হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেলেন তা নিয়ে। ঘটনার তদন্ত চেয়ে নিরঞ্জনবাবুর পরিবার হাসপাতালের সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন।
সুপার সুদীপরঞ্জন কাঁড়ার বলেন, ‘‘সমস্ত বিষয় নিয়ে তদন্ত হবে। চিকিৎসায় গাফিলতি বা নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গলদ ধরা পড়লে দোষীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ তিনি জানান, নিরঞ্জনবাবুকে আইসিসিইউ তে রাখা হয়েছে। তাঁর সুচিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। তবে নিরঞ্জনবাবুর হাসপাতাল থেকে চলে যাওয়ার জন্য তাঁর পরিবারের গাফিলতিকেও দায়ী করেছেন সুপার। তিনি জানান, হাসপাতালে প্রয়োজনের তুলনায় নিরাপত্তাকর্মী কম। তাই রোগীর পরিবারের দু’জনকে রোগীর কাছে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। তাঁদেরও লক্ষ্য করা উচিত ছিল।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং রোগীর পরিবার সূত্রে খবর, বাউড়িয়ার চককাশী শরতপল্লির বাসিন্দা নিরঞ্জনবাবুকে গত ১১ অগস্ট, বৃহস্পতিবার উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। তাঁর পাইলসের অসুখ ছিল। শয্যা না থাকায় তাঁকে হাসপাতালের দোতলায় পুরুষ মেডিসিন বিভাগের বারান্দায় রাখা হয়েছিল। রবিবার ভোর ৫টা নাগাদ হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে তিনি সটান চলে যান হাওড়া-খড়্গপুর শাখার উলুবেড়িয়া স্টেশনে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ৬টা নাগাদ স্টেশনের ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে আপ মেদিনীপুর লোকাল ঢোকার সময় আচমকা এক বৃদ্ধ ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দেন। তবে ট্রেনের গতি কম থাকায়, বড় বিপদ হয়নি। মারাত্মক জখম অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতালে অজ্ঞাত পরিচয় হিসাবে ভর্তি করায় রেল পুলিশ।
নিরঞ্জনবাবুর বড় মেয়ে শীলা সামন্ত বলেন, ‘‘সকাল ৭টা নাগাদ আমি হাসপাতালে আসি। কিন্তু ভিজিটিং কার্ড আনতে ভুলে যাওয়ায় আমাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সকাল ১০টায় ভিজিটিং আওয়ার-এ আমি ঢুকে দেখি বাবা নেই। আশেপাশের রোগীরা আমাকে জানান বাবা নাকি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন। তাঁকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে এখানেই আনা হয়েছে।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘নীচে পুরুষ শল্য বিভাগে গিয়ে দেখি অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করে বাবাকে মেঝেয় ফেলে রাখা হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের জানালেও তাঁরা গুরুত্ব দেননি। উল্টে আমাকে বলেন, আপনার বাবাকে এখান থেকে নিয়ে যান। নয়তো আপনাদের পুলিশে দেওয়া হবে।’’
নিরঞ্জনবাবুর ছোট জামাই বাদলবাবু বলেন, ‘‘শনিবার সারা রাত শ্বশুরমশাই যন্ত্রণায় চিৎকার করছিলেন। কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসকের কাছে গেলেও কোনও ওষুধ দেওয়া হয়নি।’’ নিরঞ্জনবাবুর পাশেই ছিলেন এমন একজন রোগী বলেন, ‘‘রবিবার ভোর ৫টা নাগাদ ওঁর জামাই চলে যাওয়ার পরে উনি ছটফট করছিলেন। শুধু বলছিলেন যন্ত্রণায় টিকতে পারছি না। তারপরে উঠে বেরিয়ে যান। ভাবলাম শৌচাগারে গিয়েছেন। তারপরেই শুনি এই ঘটনা।’’
এদিন সকাল ৯টা নাগাদ পুরুষ শল্য বিভাগে গিয়ে দেখা গেল, নিরঞ্জনবাবু বারান্দায় শুয়ে। হাঁটুর নীচ থেকে কাটা দু’টি পায়ে ব্যন্ডেজ বাঁধা। বললেন, ‘‘পাইলসের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছিলাম না। ওষুধ চাইলেও দেওয়া হয়নি। তাই জীবন শেষ করতেই রেললাইনে মাথা দিতে যাই।’’ বিষয়টি জানাজানি হতেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। রবিবার হলেও হাসপাতালে চলে আসেন সুপার। নিরঞ্জনবাবুকে একটি শয্যা দেওয়া হয়। সুপার নিজে তাঁকে পরীক্ষা করে আইসিসিইউ-তে রাখার ব্যবস্থা করেন।
নিরঞ্জনবাবু চলে যাওয়ার পরে সকাল ৭টা নাগাদ হাসপাতালের পক্ষ থেকে থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করা হয়। অথচ তাঁকে যখন অজ্ঞাত পরিচয় হিসাবে ফের রেল পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি করায় তখন তাঁর পরিচয় জানার কোনও চেষ্টাই করা হয়নি হাসপাতালের তরফে। অজ্ঞাত পরিচয় হিসাবেই অস্ত্রোপোচার করে বারান্দায় ফেলে রেখে দেওয়া হয় তাঁকে। সুপার জানান, এই গাফিলতিরও তদন্ত হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy