বৃহস্পতিবার বোমাবাজির পরে। নিজস্ব চিত্র।
পেরিয়ে গিয়েছে ২৪ ঘণ্টারও বেশি। কিন্তু শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত চুঁচুড়ার রবীন্দ্রনগরে দুষ্কৃতী-তাণ্ডবের ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। ফলে, পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে ক্ষোভ বাড়ছে সাধারণ মানুষের। বাড়ছে আতঙ্কও।
এ দিন রবীন্দ্রনগর বাজারের দোকানপাট খুলেছে। কিন্তু ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের আশঙ্কা, দুষ্কৃতীদের লড়াই আরও বাড়বে। এ বার শুরু হবে বদলা নেওয়া। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির অভিযোগ, শাসকদলের দুই নেতার ছত্রছায়ায় থাকায় চুঁচুড়ায় দুষ্কৃতীদের দুই গোষ্ঠীর এত বাড়বাড়ন্ত।
পুলিশের দাবি, বৃহস্পতিবারের ঘটনায় নিহত তারক বিশ্বাসের দোকানের সিসিটিভি-র ফুটেজ দেখে দুষ্কৃতীদের চিহ্নিত করা গিয়েছে। এলাকার দখল নিতেই হামলা হয়। ফুটেজে দেখা গিয়েছে, মোটরবাইকে চড়ে এসে বিশাল দাস নামে এক দুষ্কৃতী বোমা হাতে ঘুরছে। সে-ই হামলাকারী দলটির পাণ্ডা বলে তদন্তকারীদের দাবি। পুলিশ সুপার সুকেশ জৈন বলেন, ‘‘দুষ্কৃতীদের চিহ্নিত করা গিয়েছে। তল্লাশি চলছে। শীঘ্রই গ্রেফতার করা হবে।’’
তবু আশ্বস্ত হচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। হুগলির জেলা সদরে দুষ্কৃতীদের এই লড়াই কবে বন্ধ হবে, সেই প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে শহরবাসীর মনে। বস্তুত, বৃহস্পতিবার সকালে ভরা রবীন্দ্রনগর বাজারে যে ভাবে মোটরবাইকে চড়ে এসে প্রথমে এলোপাথাড়ি বোমা-গুলি ছুড়ে দুষ্কৃতীরা সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল, সেই আলোচনা এ দিনও লোকের মুখে মুখে ফিরেছে। দুষ্কৃতীরা ইমারতি সরঞ্জাম ব্যবসায়ী তারক বিশ্বাসকে গুলি করে খুন করে। তারকের বিরুদ্ধে আগে নানা অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল। গুলিতে জখম হন অভিষেক হালদার নামে এক তরুণ। বোমার ঘায়ে জখম হন চার জন।
বাজারে বেরিয়ে কেন সাধারণ মানুষকে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে চলাফেরা করতে হবে, সেই প্রশ্ন উঠছে প্রবল ভাবে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, রবীন্দ্রনগর এলাকায় দুষ্কৃতীদের দাপাদাপি কার্যত পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে। এলাকার এক প্রবীণের কথায়, ‘‘রবীন্দ্রনগর যেন দুষ্কৃতীদের মুক্তাঞ্চল হয়ে গিয়েছে।’’ এক ব্যবসায়ীর অভিযোগ, ‘‘জমি-বাড়ি কেনাবেচা থেকে ফ্ল্যাট তৈরি— সব ক্ষেত্রে দুষ্কৃতীদের ‘তোলা’ দিতে হয়। ওরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘোরে। ঘাঁটাবে কে?’’
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, দীর্ঘদিন ধরেই চুঁচুড়া এবং আশপাশের এলাকার দখল রয়েছে সমাজবিরোধী টোটনের হাতে। নিহত তারক তার দাদা। তারক জামিন পেলেও টোটন জেল খাটছে। পুলিশের একাংশের বক্তব্য, টোটনের সাম্রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরেই ভাগ বসাতে চাইছিল সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় নামে এক দুষ্কৃতী। তার হাত ধরেই অন্ধকার জগতে হাত পাকায় বিশাল। গত বছরের অগস্ট মাসে গৌতম সেন নামে এক গাড়ি-চালককে খুনের অভিযোগ ওঠে বিশালের বিরুদ্ধে। তার আগে ২০১৪ সালের এপ্রিলে টোটনের দাদা সঞ্জীবকেও গুলি করে খুনের চেষ্টাতে সে অভিযুক্ত। সেই ঘটনায় একটি গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে এক রং-মিস্ত্রির প্রাণ কাড়ে। ওই বছরেরই মার্চে এক বৃদ্ধাকে খুন করে তাঁর গলার হার ছিনতাইয়েও অভিযুক্ত বিশাল। কোনও ঘটনাতেই বিশালকে গ্রেফতার করা যায়নি।
বিরোধীদের অভিযোগ, ওই সমাজবিরোধীরা মূলত দুই তাবড় তৃণমূল নেতার ছত্রছায়ায় থাকায় পুলিশ তাদের ঘাঁটায় না। বিজেপির ওবিসি মোর্চার রাজ্য সভাপতি স্বপন পাল বলেন, ‘‘দুষ্কৃতীদের জন্য সাধারণ মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। ঐতিহ্যবাহী শহরটার সুনাম নষ্টের দায় তৃণমূল নেতারা এড়াতে পারেন না।’’ বিরোধী দলনেতা তথা চাঁপদানির কংগ্রেস বিধায়ক আব্দুল মান্নানের কথায়, ‘‘দুষ্কৃতীরা তৃণমূলের কোনও না কোনও গোষ্ঠীর। তাই পুলিশ ধরছে না।’’ সিপিএমের জেলা সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘চুঁচুড়ায় তৃণমূলের এক মন্ত্রী থাকেন। অথচ, পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারছে না। পুলিশের হাত-পা বাঁধা। ওখানে মাৎস্যন্যায় চলছে।’’
অভিযোগ মানেননি চুঁচুড়ার বাসিন্দা, কৃষি বিপণন মন্ত্রী তপন দাশগুপ্ত। তাঁর দাবি, ‘‘সুদর্শনবাবুদের আমলে দুষ্কৃতীদের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। তাঁদের সময়ে আমাদের ৬ জন সমর্থক খুন হন। তাঁদের মুখে এ সব কথা মানায় না।’’ একই সুরে চুঁচুড়ার তৃণমূল বিধায়ক তপন মজুমদারও বলেন, ‘‘দুষ্কৃতীদের জন্ম দিয়েছে সিপিএমই। এক সময় দুষ্কৃতীদের তাণ্ডবে চুঁচুড়ার অনেক এলাকায় ঢোকাই যেত না। চুঁচুড়া এখন অনেকটা দুষ্কৃতীমুক্ত। তবে রবীন্দ্রনগরে পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে।’’
ময়না-তদন্তের পরে শুক্রবার তারকের দেহ এলাকায় আনা হয়। গোলমালের আশঙ্কায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়। দাদার শেষকৃত্যে হাজির থাকতে দমদম সেন্ট্রাল জেল থেকে ৬ ঘণ্টার প্যারোলে মুক্তি পেয়ে এসেছিল টোটন।
টোটনকে দেখেই শুরু হয়ে যায় গুঞ্জন— এ বার তারক খুনের বদলা নিতে চাইবে টোটনের দলবল। অন্য দিকে, বিশাল-সঞ্জয়রা এলাকায় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে আরও মরিয়া হতে পারে। ফের শুরু হবে আতঙ্কের প্রহর গোনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy